Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
মে দিবস

বুর্জোয়া শোষণের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রামের ইতিহাস


দৈনিক পরিবার | মীর হালিম  এপ্রিল ৩০, ২০২৫, ০৩:১৭ পিএম বুর্জোয়া শোষণের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রামের ইতিহাস

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা মে দিবস হিসেবে অধিক পরিচিত। দিনটি শ্রমজীবী মানুষের রক্ত আর ঘামের প্রতিচ্ছবি। এই দিনে বুর্জোয়া শোষণের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রামের ইতিহাস মনে পরে যা চলমান। শুধু একটা দিন নয়, এ যেন এক নীরব কান্না, যা যুগ যুগ ধরে শোষিত মানুষের বুকের গভীরে জমাট বেঁধে আছে। আমার মনে হয়, মে দিবসের প্রতিটি সূর্যোদয় যেন সেই অগণিত শ্রমিক ভাই-বোনদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য রাজপথে নেমেছিল, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।
তাদের সেই রক্তমাখা পথ ধরে হেঁটে আসা আজকের শ্রমিক সমাজ। হয়তো আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো তাদের হাতের স্পর্শে নির্মিত, ঝলমলে পোশাকগুলো তাদেরই নিপুণ হাতের কাজ, তবুও তাদের জীবন যেন সেই অন্ধকার কুঠুরিতেই বন্দি – অভাব আর বঞ্চনার বেড়াজালে। টিভিতে যখন দেখি লাল পতাকা হাতে মিছিল করছে শ্রমিকরা, তাদের চোখেমুখে একরাশ হতাশা আর চাপা ক্ষোভ, তখন আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। মনে হয়, সেই উনিশ শতকের শ্রমিকদের আর্তনাদ আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায় আট ঘণ্টা কাজের অধিকার, ন্যায্য মজুরি, আর একটুখানি মানবিক মর্যাদা – এই তো ছিল তাদের চাওয়া।
আজ কত বছর পেরিয়ে গেল, কত আইন তৈরি হলো, কত আলোচনা হলো, কিন্তু সত্যিই কি শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নত হয়েছে? বস্তির স্যাঁতসেঁতে ঘরে আজও হয়তো জ্বলে না উনুন, শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে, আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যায়। মে দিবস যেন একটা আয়না, যেখানে আমরা দেখতে পাই আমাদের সমাজের আসল চেহারা। একদিকে উন্নয়নের জয়গান, অন্যদিকে নীরব আর্তনাদ। এই দিনটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের জীবন এত সহজ হয়েছে, তাদের জন্য আমরা কী করেছি?
আমি আইনজীবী, এই কলি যুগের কেতাদুরস্ত শ্রমিক, হয়তো সেদিনের মিছিলে যাইনি, কিন্তু মে দিবসের সেই আবেগময় ইতিহাস আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। আমি অনুভব করি সেই না-বলা কষ্ট, সেই চাপা দীর্ঘশ্বাস। আমার মনে হয়, প্রতিটি কলকারখানার ধোঁয়া, প্রতিটি ইটভাটার পোড়া মাটি যেন সেই শ্রমিকদের বেদনার সাক্ষী।
বামধারার রাজনীতির মুখ্যমন্ত্র “দুনিয়ার মজদুর এক হও” বিপ্লবী এই আহ্বানটি যুগে যুগে নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিধ্বনিত। এটি কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কর্তৃক ১৮৪৮ সালে রচিত বিখ্যাত কমিউনিস্ট ইশতেহারের শেষ পঙ্ক্তি। “ওয়ার্কিং ম্যান অফ অল কান্ট্রিজ, ইউনাইট”। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের হাতিয়ার এই স্লোগানটির তাৎপর্য ব্যাপক ও গভীর। এটি শ্রেণি সচেতনতার প্রতীক, এটি ঐক্যের আহ্বান দেয়, আন্তর্জাতিকতাবাদকে সংগঠিত করে, বিপ্লবের ডাককে প্রতিধ্বনিত করে। এই স্লোগানটি কেবল একটি ঐতিহাসিক উক্তি নয়, এটি আজও শ্রমিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী মন্ত্র।
মে দিবসের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল এবং এর শিকড় উনিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে প্রোথিত। উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে কারখানা এবং শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। তবে তাদের কাজের পরিবেশ ছিল খুবই অমানবিক। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা (দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি), কম মজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের প্রতি খারাপ ব্যবহার ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। শ্রমিকরা তাদের এই অমানবিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করে। 
১৮৮৪ সালে আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার ঘোষণা করে যে ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজকে আইনত স্বীকৃতি দিতে হবে। এই ঘোষণার সমর্থনে ১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ব্যাপক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। প্রায় ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ শ্রমিক এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। আমেরিকার শিকাগো শহরে এই ধর্মঘট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিল। ৪ঠা মে, ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিকদের একটি সমাবেশে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। হঠাৎ করে সেখানে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়, যার ফলে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও শ্রমিক নিহত হন।এই বোমা হামলার জন্য আটজন শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় এবং বিতর্কিত বিচারের পর কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সভায় ফরাসি শ্রমিক নেতা রেমন্ড লাভিনের প্রস্তাবে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হে মার্কেট স্কয়ারের শহীদ শ্রমিকদের আত্মত্যাগ এবং আট ঘণ্টা কাজের দাবির প্রতি সম্মান জানাতেই এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। 
মে দিবস শুধু একটি ছুটির দিন নয়, এটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই দিনটি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করার প্রেরণা যোগায়। আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকরা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার, তাই মে দিবসের তাৎপর্য আজও অমলিন। মে দিবসের ইতিহাস হলো শ্রমিকদের রক্ত, ঘাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস, যা তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশে মে দিবস পালনের ইতিহাস বেশ পুরোনো, অবিভক্ত ভারতে ১৯২৩ সালে প্রথম মে দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) ১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সময়কালে মে দিবস সীমিত পরিসরে পালিত হয়েছে। ১৯৫৩ সালে পল্টনে মে দিবসের একটি বড় জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর শ্রমিকরা বিপুল উৎসাহের সাথে মে দিবস পালন করে। আদমজীতে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক লাল পতাকা নিয়ে সভা, সমাবেশ ও মিছিলে অংশ নেয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১ মে কে মহান মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। এই দিনে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন মিছিল, সমাবেশ ও আলোচনার আয়োজন করে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয় শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
পেশাগত কারণে আমি দেখেছি যে সাধারণত মালিক শ্রেণি আইন মানার ক্ষেত্রে শিথিল থাকে। শ্রমিকরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়। বকেয়া বেতন, ন্যূনতম মজুরি না দেওয়া বা কম দেওয়া সংক্রান্ত মামলা। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা করানো কিন্তু তার ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেওয়া অথবা আইন অনুযায়ী ছুটি না দেওয়া সংক্রান্ত মামলা। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের মামলা। আইনসঙ্গত কারণ ছাড়া বা নিয়ম না মেনে শ্রমিকদের ছাঁটাই বা বরখাস্তের বিরুদ্ধে মামলা।  নিয়োগপত্র না দেওয়া, সার্ভিস বুক না রাখা, শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বৈষম্য করা ইত্যাদি শ্রম আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা অভিযোগ দায়ের করে। শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হলে শ্রমিকরা বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে বা শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে শ্রম আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। আইনের পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে ন্যায় বিচার পাওয়া বিলম্বিত হয়। তাই আইনের সংশোধন ও শ্রম নীতিতে ক্রমাগত সংশোধন ও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। 
এই মে দিবসে আমরা শুধু আনুষ্ঠানিকতা না করে একটু থামি, সেই অগণিত শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবি, যাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা এই মাটি, এই নির্মাণ। তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা প্রত্যেকে যেন আমাদের জায়গা থেকে একটু হলেও চেষ্টা করি। বাংলাদেশের কালজয়ী মহাপুরুষ, আমাদের মহান নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম শ্রমিকদের সম্মানে বলেছেন “আমি একজন শ্রমিক এবং এই পরিচয়ে আমি গর্ববোধ করি” যা শ্রমিকদের মর্যাদা বাড়ায় ও অনুপ্রেরণা যোগায়। বাংলাদেশে প্রচলিত শ্রম আইন মেনে চলি। তবেই হয়তো কোনো এক মে দিবসে তাদের মুখে হাসি ফুটবে, তাদের শিশুরা পেট ভরে খেতে পাবে, যাবে স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়! তাদের জীবন সত্যিই আলোয় ভরে উঠবে। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম। বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে প্রলেতারিয়েতের বৈষম্য দূর হোক, আলোয় ভুবন ভরে উঠুক! 
লেখক: অ্যাডভোকেট মীর হালিম 
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও পাবলিক পলিসি এনালিস্ট।

Side banner