Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ০৬ জুন, ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কুরবানি: আনুগত্য ও আত্মত্যাগের অন্যতম নজির


দৈনিক পরিবার | মো. বিল্লাল হোসেন জুয়েল জুন ৪, ২০২৫, ০৫:২৯ পিএম কুরবানি: আনুগত্য ও আত্মত্যাগের অন্যতম নজির

কুরবানি আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি বড় মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার ইবাদত ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। তার কোনও শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আনুগত্য স্বীকারকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। (সূরা আনআম, আয়াত : ১৬২-১৬৩) কুরবানির সমার্থক শব্দ ‘উযহিয়্যাহ’। এর আভিধানিক অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যে পশু জবাই করা হয় তাকে কুরবানি বলে।  
আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অন্যতম মাধ্যম কুরবানি। এটি একটি উত্তম ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: “কুরবানির দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কাজ আল্লাহর নিকট আর কিছুই নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন কুরবানির পশুর শিং, ক্ষুর ও লোমসমূহ নিয়ে হাজির হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানির দ্বারা নিজেদেরকে পবিত্র কর।” (তিরমিযি)  
রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন: “সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।” (ইবনে মাজাহ) হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা বহুবার বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। এবার তিনি এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান ইসমাইল দুনিয়াতে অধিকতর প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করতে আল্লাহ তাঁকে আদেশ করেছেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, আল্লাহ যাতে খুশি হন তাই তিনি করবেন। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, তখন তিনি পুত্র ইসমাইলকে বললেন, “তিনি (ইব্রাহিম) বললেন: হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী? তিনি (ইসমাইল) বললেন: হে আমার আব্বা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা আস্-সাফ্ফাত: ১০২)  
ছেলের এ সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর পেয়ে ইব্রাহিম (আ.) খুশি হলেন। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি পুত্র ইসমাইলের গলায় ছুরি চালালেন। এবারের পরীক্ষাতেও ইব্রাহিম (আ.) উত্তীর্ণ হলেন। পবিত্র কুরআনে আছে “তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম: হে ইব্রাহিম। তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে।” (সূরা আস্-সাফ্ফাত, আয়াত ১০৪-১০৫)  
আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে বেহেশত থেকে একটি দুম্বা এনে ইসমাইলের জায়গায় ছুরির নিচে শুইয়ে দিলেন। হযরত ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। এ অপূর্ব ত্যাগের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তখন হতেই কুরবানি প্রথা চালু হয়েছে।
কুরবানির নিয়মাবলি ও বিধিবিধান এর মধ্যে রয়েছে,  জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর হতে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি কেউ নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক (সাহিবে নিসাব) হয়, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। মুসাফিরের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।  জিলহজ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখ তিন দিন কুরবানির সময়। এ তিন দিনের যেকোনো দিন কুরবানি করা যায়। তবে প্রথম দিন কুরবানি করা উত্তম। ঈদুল আযহার নামাযের আগে কুরবানি করা সঠিক নয়। নামায আদায়ের পর কুরবানি করতে হয়। সুস্থ সবল ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানি করতে হয়। গরু, মহিষ এবং উটে এক হতে সাত জন পর্যন্ত শরিক হয়ে কুরবানি করা যায়। কুরবানির ছাগলের বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। দুম্বা ও ভেড়ার বয়স ছাগলের মতো। তবে ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি এরূপ মোটাতাজা হয় যে, এক বছরের অনেকগুলো দুম্বার মধ্যে ছেড়ে দিলে চেনা যায় না, তবে সেরূপ বাচ্চা দিয়ে কুরবানি জায়েয। কিন্তু ছাগলের বাচ্চার বয়স এক বছর না হলে কুরবানি জায়েয হবে না।
নিজ হাতে কুরবানি করা উত্তম। কুরবানির প্রাণী দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে কিবলামুখী করে, ধারালো অস্ত্র দ্বারা ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হয়। কোরবানির পশু ত্রুটিমুক্ত হতে হবে।
প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কুরবানির সময় একাগ্রতার সাথে উত্তম পশু কুরবানি করা। তাতে তাঁরা অনেক সাওয়াব পাবে। পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়বে এবং হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কোরবানি শুধু পশু জবেহ করাই নয়, কোরবানি হলো নিজের ভেতরের পশু সত্তাকে জবেহ করা। তার মানে মনের সব কুপ্রবৃত্তিকে খতম করা। কোরবানি করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য ও নির্দেশ মানার শিক্ষা গ্রহণ করে। কোরবানির দিন মুসলমানরা একে অপরের সঙ্গে মহামিলনে মিলিত হয়। এদিন ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এতে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি হয়।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি। (সূরা হাজ্ব; আয়াত-৩৪)’
এরপর অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করল এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করলেন। (সুরা সাফফাত, আয়াত-১০৩)
অর্থাৎ এমনভাবে কাত করে শুইয়ে দিলেন, যেমন পশুকে যবেহ করার সময় ক্বিবলা মুখে কাত করে শোয়ানো হয়। কপাল বা মুখমন্ডলের উপর (অধোমুখে) শোয়ানোর অর্থ করার কারণ হল, প্রসিদ্ধি আছে যে, ইসমাঈল (আঃ) নিজেই কাত করে শোয়ানোর জন্য বলেছিলেন। যাতে তাঁর মুখমন্ডল আব্বার সামনে না থাকে এবং পিতৃস্নেহ আল্লাহর আদেশের উপর প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।
পবিত্র কুরআনে আল্রাহ বলেন, ”আর আমি তার পরিবর্তে যবেহযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম” (সুরা সাফফাত, আয়াত-১০৭) ‘যবেহযোগ্য মহান জন্তু’ একটি দুম্বা ছিল, যা আল্লাহ তাআলা জান্নাত থেকে জিবরীল মারফত পাঠিয়েছিলেন। (ইবনে কাসীর) ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে সেই দুম্বাটি যবেহ করা হয়েছিল।
পিতা-পুত্রের এ আত্মত্যাগ আল্লাহর দরবারে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সব উম্মতের মধ্যে তা স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখলেন। কুরআনে বলা হয়েছে- আর আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে ইব্রাহিমের (আ.) এই সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। (সুরা সাফ্ফাত, আয়াত-১০৮)।
কোরবানির চামড়া সদকা করে দেওয়াই সবচেয়ে ভালো। তবে কেউ চাইলে কাজেও লাগাতে পারে। টাকার বিনিময়ে বিক্রি করলে সে টাকা অবশ্যই সদকা করে দিতে হবে।কোরবানির চামড়া মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের দান করা যায়। এতে দিগুণ সওয়াব হবে। একটি সদকার, অপরটি ইলমে দ্বীন প্রচারের কাজে সহায়তা করার।
কোরবানি করা পশুর মাংস বণ্টন ও চামড়ার ব্যবহার নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছুটা অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সবচেয়ে উত্তম হলো, কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করবে। একভাগ গরিব-মিসকিনকে দেবে। আরেকভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের দেবে। আরেকভাগ নিজের পরিবার পরিজনের জন্য রাখবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত—রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরবানির মাংস এক ভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন। এক ভাগ গরিব প্রতিবেশীদের দিতেন আর এক ভাগ গরিব মিসকিনদের দিতেন। মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বলেন, তোমরা উহা (কোরবানি) হতে আহার করো এবং দুস্থ অভাবগ্রস্তদের আহার করাও (সুরা হজ, আয়াত ২৮)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরবানি সম্পর্কে বলেছেন, তোমরা নিজেরা খাও এবং অন্যদের আহার করাও আর সংরক্ষণ করো (বোখারি হাদিস ৫৫৬৯)। কোরআনের অন্য জায়গায় বর্ণিত হয়েছে, সারিবদ্ধভাবে কোরবানির যন্ত্র বাঁধা অবস্থায় তাদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করো। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায়, তখন তোমরা তা থেকে আহার করো এবং আহার করাও (সুরা হজ, আয়াত ৩৬)।
কোরবানির পশুর গোশত নিজে খেতে গরিব অসহায় দরিদ্রদের খাওয়াতে ইসলাম উদ্বুদ্ধ করেছে। যাতে মুসলিম সমাজে বৈষম্য তৈরি না হয়ে, পরস্পরে আন্তরিকতার বন্ধন সৃষ্টি হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলেন, কোরবানির পশুর এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-প্রতিবেশীর জন্য, এক-তৃতীয়াংশ মিসকিনদের জন্য। আরেক বর্ণনায় এসেছে, বিখ্যাত সাহাবি ইবনে মাসুদ (রা) তার কোরবানির পশুর মাংসের তিনটি ভাগ করতেন, এক ভাগ নিজেরা খেতেন, এক ভাগ যাকে ইচ্ছে তাকে খাওয়াতেন এবং এক ভাগ ফকির মিসকিনদের খাওয়াতেন। হাদিসে ভাগের কথা পাওয়া যাওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি কোরবানির সমুদয় গোশত একাকী ভক্ষণ করেন, তবুও তার কোরবানি বৈধ হবে। কোরবানির মাংস নিজেরা খাওয়াও মুস্তাহাব ও সওয়াবের কাজ। কারও যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোরবানির মাংসের পুরোটাই নিজের পরিবারের জন্য রাখতে পারে। তবে এটা চরম বখিলতার নিদর্শন, যা নবীর শিক্ষার পরিপন্থি। প্রকৃত ইমানদারের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশা নয়।
মহিমান্বিত এই ইবাদতটি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম শর্তই হচ্ছে তাকওয়া বা একনিষ্ঠতা। যার বর্ণনা পবিত্র কালামে এসেছে এভাবে - “আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন তা হচ্ছে এই যে, যখন তারা দুজনে কোরবানি পেশ করল তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো, অন্যজনের কোরবানি কবুল হল না”। তখন সে তার ভাইকে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বললো, আল্লাহ তো মুত্তাকিনদের কোরবানিই কবুল করেন (সূরা মায়িদা, আয়াত-২৭ ও ২৮)।’
কোরবানি গ্রহণ হওয়ার মূল উপাদান তাকওয়া বা খোদা ভীরুতা। কুরআনে এরশাদ করেছেন- “আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত কোনো কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া” (সূরা হজ, আয়াত-৩৭)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাছির (র.) তার গ্রন্থে একটি সহিহ হাদিসের বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন- “আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের দৈহিক রূপের দিকে দেখেন না এবং তোমাদের দিকেও তাকান না বরং দৃষ্টি থাকে তোমাদের অন্তরের ওপর ও আমলের ওপর”।
(মো. বিল্লাল হোসেন জুয়েল, সহকারী অধ্যাপক সমাজকর্ম বিভাগ, বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ ও সাংবাদিক, গবেষক)

Side banner