ইসলামিক ক্যালেন্ডার চন্দ্র পরিক্রমার উপর ভিত্তি করে চলে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা ইংরেজী সন চলে সূর্যের গতির উপর ভিত্তি করে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে একটি মাসে ৩০ বা ৩১ দিন থাকে। চন্দ্র ক্যালেন্ডারে একটি মাস চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে ২৯ বা ৩০ দিনে হয়। একটি নতুন মাস শুরু হয় যখন পুরনো মাসের ২৯তম দিনে নতুন চাঁদ দেখা যায়। যদি এটি ২৯ তারিখে দেখা না যায়, তাহলে চলমান মাস ৩০ দিন পূর্ণ হয় এবং পরের দিন একটি নতুন মাস শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের যেখানে ৩৬৫ দিন থাকে, ইসলামিক ক্যালেন্ডারে ৩৫৪ দিন ১২ মাসে বিভক্ত হয়। এই বছর, ইসলামি নববর্ষকে ১৪৪৭ হিজরি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহানবী (সা.) এর হিজরতের বছরকে প্রথম বছর ধরে হযরত উমর (রা.) এর খিলাফতকালে ইসলামিক ক্যালেন্ডার গণনার সূচনা হয়। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যগতভাবে সম্পৃক্ত। মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও ইবাদত–বন্দেগী চন্দ্র তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আরবি তারিখ চর্চায় রাখার জন্য হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন প্রিয় নবীজি (সা.) এর হিজরতের বিরহ–বিচ্ছেদ যন্ত্রণাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, নবী প্রেমে উজ্জীবিত করে।
১৪৪৬ বছর আগে হযরত মহম্মদ ও তাঁর অনুগামীরা মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে কুরাইশদের অত্যাচারে রওনা হতে বাধ্য হন। সেই দিনটি ছিল মহররমের প্রথম দিন। মহররমের দশম দিনটি অশুরা হিসেবে পালিত হয়। ৬১ হিজরিতে মহররমের ১০ তারিখ সংঘটিত হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনা। জালিম ও দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারের সব পুরুষ সদস্যসহ (কেবল ইমাম যেইনুল আবিদিন আ. ছাড়া) ইমামের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং নবী-পরিবারের প্রেমিক একদল মুমিন মুসলমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল কারবালায়।
মহররম শব্দটির অর্থ ‘অনুমতি নেই’, ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘সম্মানিত’। তাই এই দিনে মুসলমানদের যুদ্ধের মতো ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ। এই দিনটি মুসলিমদের প্রার্থনা এবং আত্ম-চিন্তা বা আত্মা-অনুসন্ধানের দিন হিসাবেও পালিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এসব স্মৃতির সম্মানার্থে এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হিজরী বছরের চারটি ‘হারাম’ মাস: মুহররম, রজব, যিলকাদ ও যিলহাজ্জ মাস। ইসলামী শরীয়তে এ মাসগুলো বিশেষভাবে সম্মানিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। মহান আল্লাহ বলেছেন: “নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে গণনায় মাস বারটি, তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না।” (তাওবা: আয়াত-৩৬)
বিদায় হজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে প্রদত্ত খোতবায় রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্মানিত মাসগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন: “তিনটি মাস হল ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ ও মহররম, অপরটি হল রজব।” [বুখারী: ৩১৯৭; মুসলিম: ১৬৭৯] আবু বাকরাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় সময় আবার ঘুরে তার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফিরে এসেছে। যে পদ্ধতিতে আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিনের মত। মাসের সংখ্যা বারটি। তন্মধ্যে চারটি হচ্ছে, হারাম মাস। তিনটি পরপর যিলকদ, যিলহজ, ও মুহাররাম। মুদার গোত্রের রজব মাস, যা জুমাদাস সানী ও শাবান মাসের মাঝখানে থাকে। [বুখারী ৪৬৬২; মুসলিম: ১৬৭৯] এ মাসকে সহীহ হাদীসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “রমজানের রোজার পরে সর্বোত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহার্রাম মাস।’’ এ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সিয়াম পালন করতেন, তাঁর উম্মাতকে সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন এবং ১০ তারিখের সাথে ৯ বা ১১ তারিখেও সিয়াম পালন করতে উৎসাহ দিয়েছেন। আগে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নত হয়ে যায়। তবে সুন্নত রোজার মধ্যে আশুরার রোজা ফজিলতপূর্ণ।
উম্মুল মুমিনিন হযরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) চারটি কাজ কখনো পরিত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, আইয়ামে বিদের (প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) রোজা, ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হইতে বর্ণিত, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ। (সহিহ মুসলিম) হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করত। এরপর হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন তা পরিত্যাগ করা হলো। যার ইচ্ছা রাখত, যার ইচ্ছা রাখত না। (সহিহ বুখারি)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা.) মদিনা আগমন করার পর দেখলেন, সেখানকার ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কীসের রোজা রাখো? তারা বলল, এটি একটি কল্যাণময় দিন। এই দিনে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল মূসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গী বনী ইসরাঈলকে ফিরআউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং ফিরআউন ও তার সঙ্গীদেরকে ডুবিয়ে মারেন। তাই মুসা (আঃ) এ দিন রোজা পালন করেছিলেন। তাই আমরাও মুসা (আঃ) এর অনুসরণে এ দিনটিতে রোজা পালন করি। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি তোমাদের চেয়ে মুসা (আ.)-কে অনুসরণ করার বেশি হকদার। এরপর তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল, ইহুদিরা তো এই দিনটিকে মহান দিন মনে করে। এ দিনে তারাও রোজা পালন করে। আমরা যদি এ দিনে রোজা রাখি তাহলে তো এদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে।’ তাদের প্রশ্নের জবাবে নবীজি (সা.) বলেন, তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা রাখে, আগামী বছর ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করবো, ইনশাআল্লাহ। (মুসলিম: ১১৩৪) হযরত রুবাই বিনতে মুআউওয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, হযরত (সা.) আশুরার দিন সকাল বেলা আনসারদের মহল্লায় মহল্লায় এ ঘোষণা দেওয়ার জন্য লোক পাঠালেন যে, যে ব্যক্তি রোজা রাখেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ রোজা অবস্থায় থাকে আর যে রোজা রেখেছে সে যেন রোজা পূর্ণ করে। হযরত রুবাই (রা.) বলেন, আমরা নিজেরা রোজা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদের রোজা রাখাতাম। আর তাদের জন্য রঙিন পশম দ্বারা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। কেউ কান্নাকাটি করলে সেটা তাকে দিতাম যেন ইফতারের সময় পর্যন্ত রোজা অবস্থায় থাকে। (সহিহ মুসলিম) হযরত আবু কাতাদা (রা:) হযরত মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, আরাফার দিন রোজা রাখলে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর বিনিময়ে আগের ও পরের এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেন। আর আশুরার দিন রোজা রাখলে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর বিনিময়ে পূর্বের এক বছরের গুনাহ মোচন করবেন।
(সহিহ মুসলিম) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, জাহেলি জামানার লোকেরা আশুরার দিন রোজা পালন করত। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে হযরত (সা.) এবং মুসলমানগণও এ দিন রোজা পালন করতেন। পরবর্তী সময় রমজানের রোজা ফরজ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আশুরার দিন আল্লাহর দিনগুলোর মধ্য থেকে একটি দিন। যার ইচ্ছা সে এ দিন রোজা রাখতে পারে আর যার ইচ্ছা রোজা বাদও দিতে পারে। (সহিহ মুসলিম) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, আশুরার দিন রোজা রাখো এবং এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের বিরোধিতা করে এর আগের দিন বা পরের দিন রোজা রাখো। (মুসনাদ আহমদ)
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, আশুরার রোজা দুটি রাখা উচিত। এ বছর মহররমের ১০ তারিখ রোববার (৬ জুলাই) একটি, আর এর আগে মহররমের ৯ তারিখ শনিবার (৫ জুলাই) অথবা পরের দিন মহররমের ১১ তারিখ সোমবার (৭ জুলাই) আরও একটি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হিজরি বছরের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেখানোর তাওফিক দান করুন। মহররমে বেশি বেশি নফল ইবাদত ও আশুরায় রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মো. বিল্লাল হোসেন জুয়েল
সহকারী অধ্যাপক বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ
সাংবাদিক ও গবেষক।
আপনার মতামত লিখুন :