গুণগত শিক্ষা একুশ শতকের একটি অন্যতম চাওয়া। গুণগত শিক্ষা এমন একটি পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা যার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীকে সামগ্রিকভাবে সাহায্য করা যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজে একজন পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল নাগরিক হয়ে ওঠে। একবিংশ শতাব্দীর এই পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একুশ শতকের এই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে অভিযোজন করতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সহযোগিতা এবং নেতৃত্ব, অভিযোজনের যোগ্যতা অর্জন, উদ্যোক্তা, কার্যকর মৌখিক এবং লিখিত যোগাযোগের সক্ষমতা, তথ্য ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করা এবং কৌতূহলী হওয়ার যোগ্যতাগুলো অর্জন করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা ও অবারিত সম্ভবনার দ্বার উন্মুক্ত করে জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষিত জাতি সমাজের সম্পদ। কিন্তু শিক্ষা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে সে সম্পদ অসাড়ে পরিণত হয়। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান ত্রুটিগুলো চিহ্নিতকরে গুণগত শিক্ষার দিকে আমাদের ধাবিত হতে হবে। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন, যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন বলতে এর গুণগত মান নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। শিক্ষার মান্নোনয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানগুলো হলো- শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক, শিক্ষাক্রম, শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন, শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ এবং ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ। ধারাবাহিকভাবে এ সকল উপাদানের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমানের টেকসই উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব।
বর্তমান যুগকে আমরা তথ্য-প্রযুক্তির যুগ বলে অভিহিত করি। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একেকটি মুঠোফোন একটি গ্রন্থাগারও বটে। কিন্তু তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের সন্তানদের ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তায়। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা নয় বরং ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা এবং অপ্রাপ্তির হতাশা শিশুদের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন তুলবো না কারণ যে শিক্ষক বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন সেই শিক্ষকই কোচিং পরিচালনা করছেন। কোচিং এ পড়লে ভালো ফলাফল করে, না পড়লে ভালো ফলাফল করে না। এখানে আমি শিক্ষকদের পাঠদানে সদিচ্ছার অভাবকে গুরুত্ব দিব। পাশাপাশি শিক্ষকদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকারের স্বদিচ্ছার অভবও এর জন্য কম দায়ী নয়।
শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি একদিকে যেমন সমাজ নির্ধারণ করে, তেমনি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র। যে জাতি শিক্ষা ও শিক্ষককে যত বেশি গুরুত্ব দেয়, তারা তত দ্রুত উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে একসময় শিক্ষকদের যে রকম শ্রদ্ধার আসনে দেখা হতো বর্তমান অবস্থা সে রকম নয়। এজন্য শিক্ষকরাও দায়ী। শ্রেণিকক্ষে না পড়ানো, ঠিকমতো ক্লাসে না আসা, প্রাইভেট ও কোচিং এর প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া, নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়া ইত্যাদি কারণে শিক্ষকরা তাদের আগের অবস্থান হারিয়েছেন। যদিও অধিকাংশ শিক্ষককে এরকম অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না, এর জন্য দায়ী গুটিকয়েক শিক্ষক।
তিন যুগ আগের শিক্ষকরা এখনকার মতো এত প্রশিক্ষণ পেতেন না বা তারা হয়তো এতটা দক্ষও ছিলেন না। কিন্তু পড়ানোর প্রতি তাদের দরদ বা নিষ্ঠা নিয়ে খুব কমই প্রশ্ন তোলা যায়। সুতরাং শিক্ষকরা যে তাদের মর্যাদার অবস্থান হারিয়েছেন, এতে শুধু রাষ্ট্রীয় বা শিক্ষাব্যবস্থার দায় দেখলে চলবে না, শিক্ষকদের নিজেদের ঘাটতিটুকুও বিবেচ্য। শ্রেণিকক্ষই হবে শিক্ষকদের যথানিয়মে সুষ্ঠু ও উন্নত পাঠদানের নিমিত্তে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার। শিক্ষকদের নিয়মিত, সফল, আধুনিক আন্তরিকতার সাথে উন্নত পাঠদানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলেই বাড়তি ও আলাদা প্রাইভেট পড়া ও কোচিং করার দরকার হয় না। বর্তমানে দেশে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর নিদর্শন ও প্রমাণ রাখতে সক্ষম হচ্ছে। প্রাইভেট পড়া হোক আর কোচিং করা হোক সুষ্ঠু পাঠদানের জন্য শ্রেণিকক্ষই যথেষ্ট। কোচিং সেন্টার নয়, শ্রেণিকক্ষই হোক শিক্ষাদানের প্রাণকেন্দ্র।
গুণগত শিক্ষা হলো এমন শিক্ষা যা শিক্ষার্থীদের তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সাহায্য করে। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, গতানুগতিক পদ্ধতির সাথে প্রযুক্তির সুবিধা সংযুক্ত করা, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিক্ষকদেরকে তাদের পাঠদান কৌশল এবং বিষয়গত জ্ঞান উন্নত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। শিক্ষকদের পেশাগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে দক্ষ এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে আয়োজিত ইন-হাউজ প্রশিক্ষন (ওহ যড়ঁংব ঃৎধরহরহম) এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাবে এবং সকল শিক্ষক দক্ষ হয়ে উঠবে।
গুণগত শিক্ষার উপাদান: গুণগত শিক্ষার উপাদান হিসেবে মানসম্মত শিক্ষকের পর্যাপ্ততা, যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, মানসম্মত শিখন সামগ্রী ব্যবহার, শিখন-শেখানো পদ্ধতির ও কৌশলের কার্যকর ব্যবহার, নিরাপদ ও সহযোগিতামূলক শিখন পরিবেশ, উপযুক্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সুসম্পর্ক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সাথে হৃদ্যতা, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুবিধা থাকতে হবে।
গুণগত শিক্ষার চ্যালেঞ্জ: গুণগত শিক্ষার মান অর্জন করতে হলে, শিক্ষক সংকট ও দক্ষতার অভাব, প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টার, শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতির বিস্তার, শিক্ষা বাজেটের অপ্রতুলতা আমাদের এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
গুণগত অগ্রগতিতে শিক্ষকের ভূমিকা: শিক্ষার গুণগত মান অগ্রগতিতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রেণিকক্ষকে প্রাণবন্ত, শিক্ষক কেন্দ্রিক না হয়ে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠদান, আইসটি দক্ষতা অর্জন করে তা কাজে লাগানো, পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে ক্লাস পরিচালনা করা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নতুন পদ্ধতি শেখা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হৃদ্যতা সম্পর্ক, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও আবেগ অন্বেষণে উৎসাহিত করা, শ্রেণিকক্ষে ইতিবাচক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, অভিভাবকদের সাথে সহযোগিতা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা, শ্রেণিকক্ষে আধুনিক শিক্ষাদানে শিক্ষককে অবদান রাখা উচিত। ‘শিক্ষক’ এমন একটি শব্দ যে শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, অন্তহীন ত্যাগ, মূল্যবোধ, আদর্শবান, অনুপ্রেরণাদানকারী, সহযোগী, শুদ্ধতা, সহায়তাকারী, ব্যক্তিত্বের একটি ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একটি ব্রত।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হতে হবে হৃদ্যতাপূর্ণ: শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে পাঠদান করলে শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন হতে বাধ্য। পিয়ার্সন ও হেইনের (২০০৬) একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষার প্রতি মনোযোগ বাড়ায়। অর্থাৎ ইতিবাচক সম্পর্ক শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তার শিখন ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। শিক্ষার্থী পাঠ প্রদানে অপারগ হলে শিক্ষক যদি তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, এতে তার মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন কি আত্মসম্মানহীনতা বা হীনমন্যতা অনুভব করে এক পর্যায়ে শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝড়ে পড়ে। শাসনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। শিক্ষার্থীকে হতে হবে অনুগত, সম্মান প্রদানে সচেতন হতে হবে তার শিক্ষকের প্রতি। একইসঙ্গে শিক্ষককেও হতে হবে শিক্ষার্থীর প্রতি স্নেহশীল। আমরা শিক্ষকগণ কয়জনইবা ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নাম জানি, তাদের পরিবারের অবস্থা, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সামজিক অবস্থার কি কখনো খোঁজ-খবর নিয়েছি। তাই শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকের হৃদ্যতা গুণগত শিক্ষার মান অর্জনের অন্যতম উপাদান।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নে থাকবে বৈচিত্র্য: একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষকে মনমুগ্ধকর করতে গেলে, বিষয়বস্তু উপস্থাপন করবেন আকর্ষণীয়ভাবে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে। সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং বিষয় সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের গভীরতা থাকতে হবে। যথাযথ; শিখন কৌশলের ব্যবহার করে পাঠে একঘেয়েমি পরিহার এবং পাঠের ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে পাঠদানে বৈচিত্র্য আনতে হবে। প্রশ্ন করার কৌশলের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ক্রমোচ্চ কাঠিন্যমান রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে ওপেন-এন্ডেড বনাম ক্লোজ-এন্ডেড, ডাইভারজেন্ট বনাম কনভারজেন্ট ইত্যাদি প্রশ্ন করার কৌশল ব্যববহার করা যেতে পারে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা সাড়া প্রদান করবে, শিক্ষক ফিডব্যাক দিবেন, শিক্ষক শিক্ষর্থীর পারস্পারিক ক্রিয়া অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে, শিক্ষকের প্রফুল্লতা ও রসবোধ, শ্রেণি উপযোগী কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণের বিশুদ্ধতা, আধুনিক উপকরণ সংযোজন, শ্রেণি কক্ষে মুভিং ও দৈহিক ভাষার প্রয়োগ করা, মুদ্রা দোষগুলি এড়িয়ে চলা এই সকল কার্যাবলি একজন শিক্ষককে সম্পাদন করা উচত।
পাঠ পরিকল্পনা: গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পাঠ পরিকল্পনার বিকল্প নেই। সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে পাঠের শিখনফল অর্জনের জন্য পাঠদান শুরুর পূর্বে প্রণীত কার্যকর পরিকল্পনাই হলো পাঠ পরিকল্পনা। একজন শিক্ষকের ক্লাসের পূর্ব প্রস্তুতি এবং কার্যকর পাঠ পরিকল্পনাই গুণগত শিক্ষার মান অর্জনে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে। পাঠ পরিকল্পনা করতে সম্মানিত শিক্ষকগণ খুব একটা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। এটা বিশাল কিছু নয়, কারণ শিক্ষক একজন অভিনেতা। তিনি আগামীদিন ক্লাসে গিয়ে কি অভিনয় করবেন, কিভাবে ক্লাসটিকে আকর্ষণীয় করবেন তার রিহার্সেল পুর্বের দিন দেয়াই হলো পাঠ পরিকল্পনা। যেমন ক্লাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের অভিবাদন জানানো, পুর্বের পাঠ যাচাই করা, নুতন পাঠ সম্পর্কে কিছু একটা দেখানো, গ্রুপে কাজ দেয়া ফিডব্যাক নেয়া, পরবর্তী দিনের উৎসসহ পাঠ দেয়া ইত্যাদি এভাবে একজন শিক্ষক পরিকল্পনা করে ক্লাস গ্রহণ করলে ফলপ্রসু একটি ক্লাস নেয়া সম্ভব। তবে ক্লাসটির বেশিরভাগ অংশই থাকবে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক। একজন শিক্ষক সহযোগি/স্কেফল্ডিং (ঝপধভভড়ষফরহম) হিসেবে ভুমিকা পালন করবে।
পাঠ পরিকল্পনার বিবেচ্য: তবে পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে গিয়ে শিক্ষককে অবশ্যই শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ধারণ ক্ষমতা, আগ্রহ, পাঠের শিখনফল নির্ধারণ, শিখনফলের সাথে সঙ্গতি রেখে পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিষয়বস্তু অনুযায়ী শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন, শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার বিনিময় এবং শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনার জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন, শিখনফল অর্জিত হয়েছে কিনা তা নিরূপণের জন্য পাঠ মূল্যায়ন করতে হবে।
পাঠ পরিকল্পনার সুবিধা: পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে পাঠদান সমাপ্ত করা যায়,পাঠদান নিয়ন্ত্রিত, সুসংগঠিত ও ধারাবাহিকভাবে সম্পাদন করা যায়, পাঠের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া যায়, উপকরণের সঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, পাঠদানকে আকর্ষণীয় করা যায়, পাঠদান কার্যকর বা ফলপ্রসু হয়, শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পাঠের মধ্যে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়, শিক্ষকের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। তাই গুণগত শিক্ষামান অগ্রগতিতে পাঠ পরিকল্পনা অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত।
শিখন পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য গ্রহণ: একজন শিক্ষার্থী চারটি মাধ্যমে শিখে যেমন; পড়া/লেখা, শুনা, দেখা এবং (শরহবংঃযবঃরপ) শরীরের বিভিন্ন অংশ নড়াচড়ার মাধ্যমে। সেখানে একজন শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানে শুধু একই পদ্ধতি ব্যবহার করলে সকল শিক্ষার্থীর শিখনফল সমানভাবে অর্জিত হবেনা। এজন্য শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত। এক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষর্থীদেরকে দলীয় কাজ, দলীয় আলোচনা, ব্রেইন স্ট্রর্মিং, প্রশ্ন উত্তর , জিগসো পদ্ধতি, রোল প্লে, ষ্টিকি নোট, প্যানেল ডিসকাশন, পেয়ার এন্ড শেয়ার ইত্যাদির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং দ্বিমুখী যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষাদান পরিচালিত হয়। এ সকল পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাঠদান তাৎপর্যমণ্ডিত হয় এবং সফল সমাপ্তি ঘটে।
আধুনিক শিক্ষণ ও শ্রেণিকক্ষ পাঠদান ব্যবস্থাপনায় শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে শিক্ষক শিক্ষার্থী আলোচনার মাধ্যমে পাঠের উদ্দেশ্য, শিখনফল, পাঠদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন ইত্যাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা এককভাবে, জোড়ায় ও দলীয় কাজের মাধ্যমে মতামত উপস্থাপন করার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব, বিশ্বাস, আস্থা ও সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে। তাই পাঠদান হবে অবশ্যই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। যার মাধ্যমে শিক্ষক কতটুকু জানেন সেটা বড় কথা নয়, শিক্ষার্থী কতটুকু জেনেছে বা জানার মধ্যে কোনো ক্রটি আছে কি না সেটা বড় কথা। পাঠদানে শিক্ষকের অংশগ্রহণ থাকে (৫-১০ শতাংশ ) সহায়কের। কোথাও কোনো ভুলক্রটি হলে শিক্ষক শুধু ভুল সংশোধন করেন শিক্ষক। পাঠদান শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ৯০-৯৫ শতাংশ। সুতরাং সুষ্ঠ পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক বিভিন্ন শিখন পদ্ধতির সমন্বয় করে পাঠদান করলে শিক্ষার্থীরা পাঠে আগ্রহী হবে এবং যৌক্তিক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন। ফলে পাঠদান কার্যক্রম সুন্দর ও আকর্ষণীয় হবে এবং গুণগত শিক্ষারমানের অগ্রগতি ঘটবে।
সহশিক্ষা কর্মসূচী: কুড়ি বছর আগেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক জলসা; সেখানে কবিতা আবৃত্তি, ইসলামী সংঙ্গীত, বক্তৃতা পরিচালনা হতো। এগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে গুণগত শিক্ষারমান অর্জনে সহশিক্ষা কর্মসূচী অন্যতম ভুমিকা পালন করতে পারে, যেমন; বিজ্ঞান ক্লাব, লেঙ্গুয়েজ ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, সংস্কৃতি ক্লাব, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, খেলাধুলা ইত্যাদি কর্মসূচী গ্রহণ করলে শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে উপভোগ করবে, নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থকবে যা গুণগত শিক্ষা অর্জনকে তড়ান্বিত করবে।
গুণগত শিক্ষা একটি জাতীয় লক্ষ্য হওয়া উচিত। এটি বাস্তবায়নের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থার সকল অংশীজনরা একসাথে কাজ করলে শিক্ষার মান উন্নয়নে গুণগত অগ্রগতি আনা সম্ভব।
মো: বিল্লাল হোসেন জুয়েল
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (সমাজকর্ম)
বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা
আপনার মতামত লিখুন :