মানুষের কল্যাণে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার নামই নৈতিক শিক্ষা। সেই সঙ্গে অপরাধ না করা এবং পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার নামই নৈতিকতা। আত্মসংযম ও অন্যের মঙ্গল ভাবনাই নৈতিক শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে জাগ্রত বিবেক দিয়ে যাঁরা মানুষের কল্যাণমুখি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হন তাঁরাই মহান মানুষ হিসেবে বিবেচিত।
রাগে-ক্ষোভে,ক্ষণিকের আনন্দে কিংবা প্রতিহিংসা-পরায়ণ হয়ে অন্যের ক্ষতি না করা,কারোর দ্বারা উপকৃত হয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে উপকারীকে উৎসাহিত করলে পরবর্তী সময়ে উপকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। মিথ্যা কথা না বলা এবং মিথ্যাবাদীদের প্রশ্রয় না দিয়ে নিজেকে পূতশুদ্ধ রাখা একজন আদর্শ মানুষের বৈশিষ্ট্য।
মিথ্যা সবসময় নিন্দিত-ঘৃণিত। এটি কোনো সফল মানুষের মধ্যে অতি মাত্রায় বিরাজমান হলে সেই মানুষটি সামাজিক সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়। বিপদে পড়লে কিংবা স্বার্থ আর অর্থের মোহে মিথ্যা অনেকেই বলে থাকে। সবচেয়ে খারাপ তারাই যারা নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য অহরহ মিথ্যা বলে। কখনো কখনো একটি মিথ্যাকে টিকিয়ে রাখতে শতসহস্র মিথ্যা বলতে হয়। অহংকার, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসা নিজেরই ক্ষতি ডেকে আনে। সমাজের এক শ্রেণি মানুষের অপার প্রতিভা থাকাসত্ত্বেও তাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, একমাত্র অহংকারের কারণে। দাম্ভিক মানুষকে প্রতিবেশীর অনেকেই এড়িয়ে চলে এবং কেউ কেউ শত্রুর দৃষ্টিতে দেখে। তারা বিপদে পড়লে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসে না। ঈর্ষা হলো প্রতিটি মানুষের গোপন ব্যাধি। এটি অনেকাংশে জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। ঈর্ষার প্রভাব যাঁর মধ্যে বেশি সে ততো অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করে। তাদের রাতে ভালো ঘুম হয় না,সারাক্ষণ অস্থিরতায় ভোগে। ক্রমান্বয়ে প্রতিহিংসার পরিধি ভয়ংকর হলে মারামারি খুনোখুনি করে আর্থিক ক্ষতি ও সম্মানহানির উপক্রম হয়।
আপনি যে কাজে পারদর্শী সেই কাজে নিজেকে মনোনিবেশ করুন। সবাই সব কাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই যদি হতো তাহলে একজন আরেকজনের প্রয়োজন হতো না। সংগীতশিল্পীর কন্ঠের গান নায়িকার ঠোঁটে যেতো না। সে কারণে বলছি,অন্যের দোতলা দেখে নিজের মনকে উতলা করে কোনো লাভ নেই।
নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও বড়ো না ভেবে নিজের মন ও বিবেককে বিলিয়ে দিন মানুষের কল্যাণে। যাপিত জীবনে মানুষের ভালোবাসার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ আর কিছুই হতে পারে না।
কৃপণ মানুষের মন বরাবরই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তারা কারো ভালোবাসা পায় না। তাদের কঞ্জুসতার কারণে কষ্ট পোহাতে হয় পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের। অন্যের ছেঁড়া জামা কিংবা ছেঁড়া জুতার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে লজ্জা দেওয়া এক ধরনের অপরাধ। বার বার কথা দিয়ে কথা রক্ষা না করলে ক্ষতির পরিমাণটা নিজেরই বেশি। ধার নেওয়া টাকা কিংবা দেনা পরিশোধ না করলে পরবর্তী সময়ে এলাকার মানুষের কাছে মূল্যহীনভাবে জীবনযাপন করতে হয়। কারণ,তারা অতীতে বিশ্বাস নামক মূল্যবান জিনিসটি ধ্বংস করে ফেলে। কোনো মানসিক রোগী কিংবা হাবলাক্যাবলা মানুষকে ক্ষণিকের আনন্দে দলবদ্ধ হয়ে অকারণে অত্যাচার-নির্যাতন করা অমার্জনীয় অপরাধ। অন্য ধর্মের কোনো মানুষকে বিনা কারণে হেয় প্রতিপন্ন করা কুরুচিপূর্ণ ও হীনমন্য হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করা।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়,আমাদের মহানবী (সা.) -এর জীবদ্দশায় ৬২২ খ্রীস্টাব্দে বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান,যা মদিনার সনদ নামে ইতিহাসে খ্যাত; এ সনদের ৪৭টি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটিতে রয়েছে,এ রাষ্ট্রে যে কোনো ধর্মের মানুষের প্রচলিত কর দিয়ে ভোটাধিকার লাভ করে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। তাদের কোনোভাবে জ্বালাতন নির্যাতন করা যাবে না। যার ফলে মহানবী (সা.) কে মহামানব বলা হয়।
দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার দেখে চুপ থাকা বিবেকহীন কাজ। শুধু তাই নয়,নিজের ক্ষমতা থাকার পরও প্রতিবাদ না করা অপরিমেয় অপরাধ। ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে বিচারের রায় ন্যায়ের পক্ষে না দিয়ে অন্যায়কারীকে জিতিয়ে দেওয়া অমানবিক ও ক্ষমাহীন অপরাধ।
নিজে খেয়ে যাচ্ছেন মাংস-ঘি-কিন্তু অভুক্ত প্রতিবেশীর দিকে নজর না দেওয়া একটি অমানবিক আচরণ। প্রতিবেশীকে আর্থিকসহ নানাবিধ সহযোগিতা করলে লাভের অংশটা নিজেরই বেশি। কারণ,বিপদ-আপদে সবার আগে এগিয়ে আসে প্রতিবেশীরা। এছাড়া আপনার মৃত্যুর পর প্রতিবেশীরা সবার আগে ছূটে আসবে জানাজার নামাজে শরীক হতে। কেউ কেউ কবর খুঁড়তে যাবে গোরস্তানে। আপনি দূরে কোথাও আত্মীয়তা করতে যাবেন। আপনি মানুষ হিসেবে কেমন,সেই পক্ষ গোপনে খোঁজ খবর নিতে আসবে আপনার প্রতিবেশীর কাছে। সুতরাং প্রতিবেশীর সাথে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা বুদ্ধিমানের কাজ।
অর্থ-বিত্তের প্রভাবে কিংবা পরিবারের সদস্যরা উচ্চশিক্ষিত হওয়ার ফলে অহংকারে স্বশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর মানুষদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা মানে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করা। যে কর্মে আনন্দ পাওয়া যায় বেশি সেদিকে গুরুত্ব দিলে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা কঠিন কিছু নয়। কর্ম ছাড়া কেউ সৎ থাকতে পারে না। এটিকে মনেপ্রাণে ধারণ করা এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে জনকল্যাণে প্রচার করা অপরিহার্য। পাঠ্যপুস্তকের লেখাপড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং পরিবারের সদস্যদের সংস্কৃতি চর্চার দিকে ধাবিত করা নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মনের পরিচায়ক।
অন্যের হক আত্মসাৎ করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া একটি অনৈতিক কাজ। মা-বাবার প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কোন ভাইবোন মা-বাবাকে সেবাযত্ন করলো কি করলো না সেদিকে না গিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। আপনি মা-বাবার সেবাযত্ন করলে দেখাদেখি আপনার সন্তানরাও ভবিষ্যতে আপনার সেবাযত্ন করবে।
সৎ মানুষের সংসার চলবে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে। এটি বিশ্বাসের মাধ্যমে লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকতে হবে। আপনার সন্তান কার সাথে চলাফেরা করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ,এক চোর আরেক চোরের সাথে হয় বন্ধত্ব,এক নেশাখোর আরেক নেশাখোর ছাড়া চলতে পারে না। সুতরাং বন্ধুর সার্কেল দেখলে বোঝা যায় আপনার সন্তান কোন অবস্থানের মানুষ ।
ধনবান,ক্ষমতাবান ও খ্যাতিমান- এই তিন শ্রেণির অধিকাংশ সন্তান সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না,শুধু পরিবারের গৌরব আর অহংকারের ফলে। বাবার অবৈধ রোজগারের ধন-সম্পদের পাহাড় দেখে সন্তানরা মনে বলে, লেখাপড়া করে কী লাভ? উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার অঢেল সম্পদ পাবো। চাকরি কেন করবো? চাকরি হলো অন্যের গোলামী করা এবং অন্যের হুকুম মেনে চলা। সুতরাং এ কাজে আমরা নেই। বাবার সম্পদ ভাগে যা পাবো তা যথেষ্ট, বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবো। ক্ষমতাবান সন্তানরা মনে করে জীবনটা ইঞ্জিনচালিত নৌকার মতো। ক্ষমতা যতোদিন থাকে ততোদিন জীবননৌকা বৈঠা ছাড়া চলে।
খ্যাতিমান সন্তানদের মধ্যে অনেকে নিজেকে উচ্চ এবং অন্যদেরকে তুচ্ছ মনে করে বাপ-দাদার নাম ভাঙিয়ে চলে। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে অভাব অনটন আর সামাজিক মর্যাদার দূর্গতি।
কোনো অনৈতিক কাজে নিজে লিপ্ত থেকে সেই কাজে অন্যকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলে কেউ তা গ্রহণ করতে চায় না। মোবাইল ফোনে কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে কোনো পরনারীকে যোগ্যতার চেয়ে বেশি প্রশংসা করে বাস্তবতা থেকে স্বপ্নের সিঁড়িতে তোলে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এটি একটি অনৈতিক কাজ। এ ধরনের উচ্চ প্রশংসা শুনে অনেক বিবাহিত নারীর মন বসে না সংসারে।
স্বামী সংসার তাদের ভালো লাগে না।
সারাদিন নিজের ছবি দেখে আবেগের জোয়ারে ভাসতে থাকে এবং মনে মনে ভাবে,তাইতো ফেসবুকের বন্ধুরা তো ঠিকই বলে,আমি সিনেমার নায়িকা হতে পারতাম এবং মডেলিংয়ে চান্স পাইতাম। পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছি বলে এই জায়গায় পড়ে আছি। এর মধ্যে কোনো কোনো নারী সংসার ছেড়ে উড়াল দেয়। যার ফলে বর্তমানে শতভাগের ৮৫ ভাগ ডিভোর্স মহিলারা আগে দিচ্ছে। সংসার ভাঙার ফলে তাদের সন্তানদের জীবন হচ্ছে বিপন্ন। অনুমতি ব্যতীত অন্যের জিনিস স্পর্শ না করা নৈতিক শিক্ষার অংশ। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যার বিবেক শিক্ষিত সে-ই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সবচেয়ে অসহ্য লাগে তখনই যখন নীতিহীন মানুষের মুখে শুনি নীতিকথা। মূল্যবোধের চর্চা হলো সবকিছুতে সঠিক মূল্যায়ন করা। দেশের সঠিক ইতিহাস রচনা করা, সৎ ও যোগ্য মানুষকে সঠিক মূল্যায়ন করা, মাতৃভূমিকে ভালোবাসা, মা-বাবাকে সেবাযত্ন করা এবং রাষ্ট্রের গোপন তথ্য বিদেশি কারোর কাছে পাচার না করা। মুরুব্বিদের মান্য করা, শিশু ও বৃদ্ধদের কোনো কাজে ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। সব সময় সত্য কথা বলা এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার নামই মূল্যবোধের চর্চা।
শাহজাহান আবদালী
কবি ও রম্যলেখক
প্রকাশিত গ্রন্থ ৭২টি।
আপনার মতামত লিখুন :