বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। আর এ নিয়ে প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। কারণ এই অপর্যাপ্ত বরাদ্দের সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।
স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে দেশের মানুষের মোট খরচের ৬৭ শতাংশেরও বেশি বহন করতে হয় নিজেদের পকেট থেকে, যা Out-of-Pocket Expenditure নামে পরিচিত। এই বিপুল খরচের কারণে প্রতি বছর দেশের প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে দিচ্ছে। পরিবারে কারও কোনো জটিল রোগ হলেই একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে কয়েক প্রজন্মের জন্য ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে যায়।
এই সংকট কিছুটা লাঘব করার জন্য বাজেট বৃদ্ধি এবং লোকবল নিয়োগ জরুরি, সেটা সত্য। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ আর লোকবল নিয়োগ করলেই সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধান আসবে না। বাস্তবে পরিকল্পনাহীনভাবে বাজেট বৃদ্ধি এবং গণহারে লোকবল নিয়োগ স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক সমস্যাগুলো যেমন অদক্ষতা ও দুর্নীতির মতো বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে বরং সেগুলোকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
বাজেট বৃদ্ধি ও ব্যাপক লোকবল নিয়োগ কেন টেকসই সমাধান নয়?
স্বাস্থ্য খাতে সংকট দেখা দিলেই বাজেট বৃদ্ধি বা বেশি করে ডাক্তার-নার্স নিয়োগের একটি জনপ্রিয় দাবি ওঠে। কিন্তু গভীরে গেলে বোঝা যায়, এই সরল পথে কিছু মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে যা খাতের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
প্রথমত, শুধু অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই সেবার মান বাড়ে না, যদি সেই টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার না হয় ও স্বচ্ছতা না থাকে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় কোটি কোটি টাকার অত্যাধুনিক মেশিন সামান্য ত্রুটির কারণে বছরের পর বছর অকেজো হয়ে পড়ে থাকে, অথচ রোগীরা বাইরে থেকে চড়া মূল্যে সেবা নিতে বাধ্য হন।
অন্যদিকে, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কারণে বরাদ্দের একটি বড় অংশ অপচয় হয়। এর পাশাপাশি, কর্মীদের অনুপস্থিতির কারণে বিশেষ করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় বরাদ্দের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। ফলে বেশি টাকা বরাদ্দ মানে বেশি সেবা নয় বরং অপচয়ের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।
দ্বিতীয়ত, নতুন ডাক্তার বা নার্স নিয়োগের ফলে তাদের বেতন-ভাতা সরকারের জন্য একটি স্থায়ী খরচে পরিণত হয়। এতে বাজেটের একটি বিশাল অংশ কেবল বেতন প্রদানেই চলে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই ওষুধ, অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাত বা স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে ফেলে।
এই সংকট কিছুটা লাঘব করার জন্য বাজেট বৃদ্ধি এবং লোকবল নিয়োগ জরুরি, সেটা সত্য। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ আর লোকবল নিয়োগ করলেই সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধান আসবে না।
এর একটি বিশাল ‘সুযোগ-ব্যয়’ (Opportunity Cost) রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিবর্তে সেই অর্থে একটি জাতীয় স্বাস্থ্যবীমা তহবিলের ভিত্তি তৈরি করা যায়, যা লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ দিতে পারে।
তাছাড়া নতুন নিয়োগ পাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি বড় অংশ ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোয়ই থাকতে চান, ফলে উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো চিকিৎসক শূন্যই থেকে যায়। অন্যদিকে ক্লিনিক্যাল স্টাফ নিয়োগে যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়, রোগ প্রতিরোধ ও জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম ততটাই অবহেলিত থেকে যায়।
অথচ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানান রোগেই প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে, বিশুদ্ধ পানি বা স্যানিটেশনের মতো প্রতিরোধমূলক খাতে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসার ব্যয় বহুগুণে কমিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মূলত ‘অসুস্থতার চিকিৎসা’ করছে, কিন্তু ‘সুস্থ রাখার’ নীতিতে বিনিয়োগ করছে না।
বিশ্বের সফল মডেল থেকে শিক্ষা
বিশ্বের অনেক দেশ সীমিত বাজেটেও স্বাস্থ্যসেবায় যুগান্তকারী সাফল্য পেয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় হতে পারে।
থাইল্যান্ড: দেশটি শুধু কর্মী নিয়োগ না বাড়িয়ে ক্যাপিটেশন মডেলে অর্থায়ন করেছে। এতে প্রতিটি নিবন্ধিত নাগরিকের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো নির্দিষ্ট বার্ষিক বরাদ্দ পায়। এর ফলে কেন্দ্রগুলো তাদের জনগোষ্ঠী সুস্থ রাখতে উৎসাহিত হয়, কারণ প্রতিরোধমূলক সেবা চিকিৎসার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী। এই মডেলটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মধ্যে দক্ষতা ও সেবার মান বাড়ানোর একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে।
শ্রীলঙ্কা: বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগের পরিবর্তে দেশটি প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এই স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিটি গ্রামে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সেবাগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে এনেছে, যা একসময় বাংলাদেশের সমপর্যায়ে ছিল।
ডাক্তার-নির্ভর মডেল থেকে বেরিয়ে এসে মিডওয়াইফ, প্যারামেডিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন করে প্রাথমিক সেবার ভিত্তি মজবুত করতে হবে।
রুয়ান্ডা: দেশটি কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার এবং পারফরম্যান্স-ভিত্তিক অর্থায়ন (Performance-Based Financing) ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটিয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো এবং এর কর্মীরা টিকাদান, প্রসব পূর্ববর্তী সেবার নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারলে বোনাস বা অতিরিক্ত অর্থ পায়, যা তাদের কাজে সরাসরি উৎসাহিত করে।
ফিলিপাইন: দেশটি তামাক ও অ্যালকোহলের ওপর ‘সিন ট্যাক্স’ (Sin Tax) আরোপ করে স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি স্থিতিশীল ও স্বয়ংক্রিয় অর্থায়নের উৎস তৈরি করেছে। এই কর থেকে অর্জিত অর্থ সরাসরি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিতে এবং সরকারি হাসপাতালের মানোন্নয়নে ব্যয় হয়, যা বাজেটের ওপর চাপ কমিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশে যা করতে পারে
১. স্মার্ট মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন:
প্রথমেই প্রয়োজন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ডাক্তারদের গ্রামে ধরে রাখতে শুধুমাত্র বাধ্যতামূলক পোস্টিং নয় বরং আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করতে হবে, যার মধ্যে থাকতে পারে বিশেষ ভাতা, আবাসন সুবিধা, সন্তানদের জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্যারিয়ার অগ্রগতির সুযোগ।
শুধুমাত্র ডাক্তার-নির্ভর মডেল থেকে বেরিয়ে এসে মিডওয়াইফ, প্যারামেডিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন করে প্রাথমিক সেবার ভিত্তি মজবুত করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কর্মীদের জন্য পারফরম্যান্স-ভিত্তিক চুক্তি এবং ডিজিটাল বায়োমেট্রিক উপস্থিতি, জিপিএস ট্র্যাকিংসহ ব্যবস্থা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি।
২. বরাদ্দ ব্যয়ের সক্ষমতা স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও নতুন উৎসের ব্যবস্থা:
বাজেট বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতালের ওপর চাপ কমিয়ে প্রতিরোধমূলক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে আউটপুট-ভিত্তিক বা ক্যাপিটেশন ফান্ডিং মডেল পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে।
UNICEF-এর সহায়তায় এরকম পাইলট ঢাকার কিছু এলাকায় চলছে, এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি, ফিলিপাইনের মতো তামাক, চিনিযুক্ত পানীয়ের মতো ক্ষতিকর পণ্যের ওপর ‘স্বাস্থ্যকর’ আরোপ করে একটি বিশেষ ও সুরক্ষিত স্বাস্থ্য তহবিল তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। এই তহবিল থেকে একটি সর্বজনীন জাতীয় স্বাস্থ্যবীমা স্কিম ধাপে ধাপে চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসার বিপর্যয়কর ব্যয় থেকে সুরক্ষা দেবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য এখন শুধু ‘আরও বাজেট’ই সমাধান নয়। অপরিকল্পিত বাজেট বৃদ্ধি রাজনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় কিন্তু টেকসই সমাধান নয়। স্বাস্থ্য খাতকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করতে হলে এর দর্শনে পরিবর্তন করতে হবে চিকিৎসাকেন্দ্রিক মডেল থেকে প্রতিরোধকেন্দ্রিক মডেলে যেতে হবে।
ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সীমিত সম্পদেও দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল
অধ্যাপক ও পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :