Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

নারী নির্যাতন: পরিবারই সহিংসতার অদৃশ্য কারখানা


দৈনিক পরিবার | মাহফুজা অনন্যা     জুন ১০, ২০২৫, ১১:৪৮ এএম নারী নির্যাতন: পরিবারই সহিংসতার অদৃশ্য কারখানা

পলাশ সাহার আত্মহত্যা হয়তো একটি ব্যক্তিগত ঘটনা, কিন্তু এর পেছনে যে মনস্তত্ত্ব ও মূল্যবোধ কাজ করেছে, তা একেবারেই ব্যক্তিগত নয়। এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা, অবজ্ঞা এবং অবিচারকে অনেকাংশে ‘স্বাভাবিক’ করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু সমাজে নারীরা শুধু স্বামী নয়, বরং শ্বশুরবাড়ি, এমনকি নিজের পরিবার থেকেও নানাবিধ শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক নির্যাতনের শিকার হন। সমাজের নীরব সহমতের বিরুদ্ধে জাগরণের সময় এখন।
নারীর নির্যাতনের বহুমাত্রিক রূপ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, নারী নির্যাতন মানেই শুধু মারধর নয়। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নারী শিকার হন মৌখিক অবমাননা, যৌন হয়রানি, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, চলাফেরার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং মানসিক নির্যাতনের। এই নির্যাতনের উৎসস্থল পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় নীতিও হতে পারে। একেকটি নির্যাতন এমনভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ঘটে যে, অনেক নারী তা স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে শেখেন।
পরিবার নারী নির্যাতনের কারখানা বললেও ভুল হবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, নারীর ওপর সহিংসতার অন্যতম প্রধান উৎস পরিবার। অনেক পুরুষ মনে করেন স্ত্রীকে ‘শিক্ষা দেওয়া’, ‘শোধরানো’, কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণে রাখা’ তাঁর অধিকার। এই ধারণাগুলো শিশুকাল থেকেই পরিবারে গেঁথে দেওয়া হয়—যেখানে মা, বোন কিংবা দাদি-নানিরাও এ ব্যবস্থার অংশ হয়ে যান। অনেক সময় দেখা যায়, পুত্রবধূর ওপর নির্যাতনের জন্য শাশুড়ি বা দেবর-ননদও পুরুষ সদস্যকে উৎসাহ দেন বা নীরব সহমত পোষণ করেন।
পুরুষের অন্ধ লোভ, চাহিদা এবং আধিপত্যবাদের পেছনে পরিবারেই গড়ে ওঠা মানসিকতা এবং বিকৃত মূল্যবোধ দায়ী। যৌতুক, আর্থিক নির্ভরতা, সন্তান না হওয়া, সন্তান মেয়ে হওয়া ইত্যাদি অজুহাতে নারী নির্যাতন যেন একটি সামাজিক নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া পরিবার কিছু সন্তানকে টার্গেট করে তার বউ, সন্তানের উপর নির্যাতন, অবহেলা, কিংবা যৌতুকের দাবি করে। অনেক সময় দেখা যায় সেই স্ত্রী অধিক যোগ্য, অধিক পরিশ্রমী, অধিক ভালো মানুষ। তারপরও পরিবার তাকে নানারকমভাবে শারীরিক মানসিক অত্যাচার করে থাকে। কখনো কখনো হত্যাও করে।
নারী নির্যাতনের পরিণতি নিয়ে বলতে গেলে, এই সহিংসতা শুধু একজন নারীর জীবনকেই ধ্বংস করে না; তা প্রভাব ফেলে তার সন্তানদের ওপর, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে করে ক্ষতিগ্রস্ত। একটি শিশু যদি প্রতিনিয়ত দেখে তার মাকে বাবার হাতে নির্যাতিত হতে, তবে সে বড় হয়ে বা তো নির্যাতক, না হয় নির্যাতনের শিকার হিসেবে গড়ে ওঠে। এতে সমাজে সহিংসতা ও অসমতার এক বিশৃঙ্খল চক্র জন্ম নেয়।
আইন প্রণয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া উত্তরণের পথ নেই! বাংলাদেশে নারী নির্যাতন দমন আইন (২০০০), পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন (২০১০) সহ একাধিক আইন থাকলেও, সেগুলোর প্রয়োগ অনেকাংশেই অকার্যকর। থানায় মামলা নিতে অনীহা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, সাক্ষীর নিরাপত্তাহীনতা নির্যাতিতা নারীদের নিরুৎসাহিত করে।
আমাদের দেশে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার পরিবর্তন খুব জরুরি। ছেলে শিশুদের ছোট থেকেই সমতা, সহমর্মিতা এবং নারীর প্রতি সম্মান শেখানো জরুরি। পরিবারকে হতে হবে ইতিবাচক মূল্যবোধের পাঠশালা, নির্যাতনের উৎস নয়। এক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকতে হবে। একজন নারীর যদি নিজস্ব আয়ের উৎস থাকে, তবে সে অনেক বেশি আত্মনির্ভর হতে পারে এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এজন্য কারিগরি শিক্ষা, চাকরি এবং উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ বাড়াতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারীদের মানসিক সাপোর্ট ও নিরাপদ আবাসনের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।
অনেক পুরুষ মনে করেন স্ত্রীকে ‘শিক্ষা দেওয়া’, ‘শোধরানো’, কিংবা ‘নিয়ন্ত্রণে রাখা’ তাঁর অধিকার। এই ধারণাগুলো শিশুকাল থেকেই পরিবারে গেঁথে দেওয়া হয়—যেখানে মা, বোন কিংবা দাদি-নানিরাও এ ব্যবস্থার অংশ হয়ে যান। অনেক সময় দেখা যায়, পুত্রবধূর ওপর নির্যাতনের জন্য শাশুড়ি বা দেবর-ননদও পুরুষ সদস্যকে উৎসাহ দেন বা নীরব সহমত পোষণ করেন।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষদেরও ভূমিকা রয়েছে। ‘পুরুষ মানেই নির্যাতক’ এই প্রচলিত স্টিরিওটাইপ ভাঙতে হবে। বরং পুরুষদের মধ্যেই সচেতন অংশকে এগিয়ে এনে, তারা যেন অন্য পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন সে বিষয়ে পুরুষদের সচেতন হতে হবে। কারণ যে নারীটি নির্যাতিত হচ্ছে সে কোনো না কোনো পুরুষেরই কন্যা। তাই নারী নির্যাতন বিষয়কে ব্যক্তিক না চিন্তা করে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
নারীর নীরবতা মানে সহমত নয়, প্রতিবাদ প্রতিকার করতে নারীদেরকে এগিয়ে আসতে হবে৷ আমরা যদি সত্যিই একটি সহিংসতামুক্ত সমাজ চাই, তবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুধু নারীকেই নয়, পুরুষ, পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি উপেক্ষা একটি নতুন নির্যাতনের পথ তৈরি করে। তাই সময় এসেছে প্রতিরোধের, সময় এসেছে পরিবার থেকে সমাজ পর্যন্ত দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরের।
লাভের কাছে বিবেকের হার, যৌতুক প্রথা ও পারিবারিক সহিংসতার অদৃশ্য কারখানা এই পরিবার। যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি সহিংস হয়, তখন সেটিকে অনেক সময় ‘দাম্পত্য কলহ’ বলে হালকাভাবে দেখা হয়। কিন্তু এই কলহের পেছনে যে একটি গভীর, লোভনীয়, নিষ্ঠুর মানসিকতা কাজ করে—তা অনেকে বোঝেও না, বোঝার চেষ্টাও করে না। যৌতুক এবং আর্থিক লাভের আশায় বহু পুরুষ স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালায়, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না। বিষয়টি আরও ভয়াবহ হয় যখন দেখা যায়, সেই সহিংসতার পেছনে পুরুষটির মা-বাবা, ভাই-বোন সক্রিয়ভাবে মদদ দিচ্ছে কিংবা চুপ থেকে তা মেনে নিচ্ছে বা উসকে দিচ্ছে।
এভাবে ধীরে ধীরে পরিবারেই পুরুষের পশুত্বের জন্ম হয়। একজন পুরুষ যখন বিয়ের পরও স্ত্রীর বাবার কাছ থেকে আরও টাকা, গহনা বা ফ্ল্যাট চায়—তখন সে আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে পুঁজিপতি মানসিকতার একজন শোষক। এই মানসিকতা পরিবার থেকেই জন্ম নেয়। অনেক মা-বাবা ছেলেকে শেখান, “তোর বিয়েতে যেন ভালো যৌতুক আসে”, “বউয়ের বাপের অবস্থা ভালো, কিছু চাইতে পারিস”। এটি যেন এক ধরনের সামাজিক চুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে—মেয়ে দিলেই সঙ্গে সম্পদ দিতে হবে, না হলে সে ঘরে ‘মূল্যহীন’। এগুলো পারিবারিক প্ররোচনা যা একজন পুরুষের মা, বোন শেখায়।
পরিবারের প্ররোচনার রূপ কত ভয়ংকর হতে পারে তা আমরা প্রতিদিনের গৃহবধূর হত্যা বা আত্মহত্যা থেকে অনুমান করতে পারি। ছেলের বউয়ের পরিবার থেকে কিছু পাওয়ার আশা প্রকাশ করা, না পেলে অবজ্ঞা করা বা বউকে ‘অপমানিত অতিথির মতো রাখা হয়, এতে স্বামী কাপুরুষ হলে চুপ করে মেনে নেয়। আর কখনো কখনো সে নিজেও অত্যাচারের শীর্ষে অবস্থান করে। শুধু তাই নয়, স্বামী পুরুষটির ভাই বোনের লোভও থাকে। বউয়ের বাড়ি থেকে দেওয়া জিনিস কে পাবে তা নিয়ে ঝগড়া, বিয়ের সময় বোন বা ভাবির জন্য গহনা চাওয়া—এসবই যৌতুক লোভের পরোক্ষ চেহারা। এই লোভের পরিণতিতে একসময় দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যায়। কারণ ভালোবাসা, সম্মান ও নিরাপত্তাহীন সংসারে টিকতে পারে না। যদিও বা টিকে থাকে তা প্রতিনিয়ত কলহের মধ্যে, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন সহ্য করে।
এভাবে চললে নারীর আত্মবিশ্বাস ধ্বংস হয়। সে নিজেকে ‘বোঝা’ মনে করতে শুরু করে। সন্তানরাও বিকৃত মানসিকতায় কিংবা হতাশায় বেড়ে ওঠে। ছেলেরা হয় ভবিষ্যতের নির্যাতক, নইলে ভীত দিশাহীন, মেয়েরা হয় চুপ থাকা শিখে যাওয়া ভীত নারীর প্রতিচ্ছবি। বহু নারী আজও যৌতুকের কারণে খুন হচ্ছে, গায়ে আগুন দেওয়া হচ্ছে, বিষ খাওয়ানো হচ্ছে।
ছেলে সন্তানের পরিবারকে শেখাতে হবে—বউ মানে ধনসম্পত্তি নয়, একজন সম্মানিত জীবনসঙ্গী। পারিবারিক শিক্ষার পরিবর্তন করতে হবে। বিয়েতে যৌতুক না নেওয়ার সামাজিক প্রতিজ্ঞা। যেমনটা গ্রামে বা কমিউনিটিতে গণস্বাক্ষর বা শপথের মাধ্যমে চালু করা যায়।
তাছাড়া যৌতুক দাবির প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষ করে পরিবারকে আইনের কঠোরতার আওতায় আনতে হবে। নারীর পরিবারকে না বলতে শিখতে হবে আত্মীয়তা রক্ষা বা ‘মেয়েকে সুখে রাখতে’ যৌতুক দেওয়া কখনোই সমাধান নয়, বরং তা অপরাধকে আরও উৎসাহিত করে।
যৌতুকের লোভ মানুষকে শুধু পশুতে পরিণত করে তা নয়—এ লোভ একজন মানুষকে পশুর চেয়েও ভয়ানক করে তোলে। কারণ পশু তার প্রয়োজনেই আক্রমণ করে, কিন্তু যৌতুকের লোভী মানুষ তা করে লোভ, অহংকার ও অবমাননার বোধ থেকে। এই সমাজে যতদিন না পরিবারগুলো সাহস করে বলবে—“না, আমাদের ছেলের কোনো বিনিময় মূল্য নয়, বউ চাই ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে”, ততদিন নারীরা নিরাপদ হবে না।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক। ‎

Side banner