প্রস্তর যুগ থেকে শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাস। তখনো আবিষ্কার হয়নি খনিজ পদার্থ। এই যুগে ক্ষুধার প্রয়োজনে মানুষ পাথর দিয়ে হাতিয়ার তৈরী করে শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। এই প্রস্তর যুগেকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করা হয়- শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ পর্ব, কৃষি ও জনপদ পর্ব, পেশা হিসেবে কৃষি ও জনপদ পর্ব এবং ধাতু আবিষ্কার পর্ব। প্রস্তর যুগের এই সবগুলো পর্বের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ফিলিস্তিনে পাওয়া গেছে।
এ অঞ্চলে বছর জুড়ে বৃষ্টি হয়। শীত কিংবা গ্রীষ্ম সবসময়ই তাপমাত্রা ১৯-২৭ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। ফিলিস্তিন হল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মিলনস্থল। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে মিশর পূর্বে জর্ডান এবং উত্তরে ইসরায়েল। এ দেশে নগরায়ণের জন্য খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দে এখানেই মানুষ সর্বপ্রথম সমবেত হয়েছিল। সেই নগরের নাম আরীহা। আরিহা নগরীর পতনের পর থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও অসংখ্য নবী-রাসুল এই পবিত্র ভূমিতে বাসস্থান গড়ে তুলেছেন।
যতগুলো সম্প্রদায় ফিলিস্তিনে বসবাস করেছে তাদের মধ্যে কেনআনি সম্প্রদায় সর্বাধিক প্রাচীন। কেনআনি সম্প্রদায় আনুমানিক ৪৫০০ বছর আগে আরব উপদ্বীপ থেকে এ অঞ্চলে আগমন করে। তারা সিরিয়ার নিকটবর্তী ফিলিস্তিনী এলাকায় বসবাস করত। এতে ইহুদীরা যে দাবি করে, তারা ফিলিস্তিনের প্রথম বাসিন্দা-এর অসারতা প্রমাণ হয়।
তাদের হাতে বিকৃত তাওরাতও স্বীকার করে, ইহুদীদের আগে কেনআনীরাই ফিলিস্তিনের বাসিন্দা ছিল। নাবলুস, বাইসান, আক্কা, আসকালান, হাইফাসহ দুই শতাধিক শহর তারা গড়ে তুলেছিল। ইহুদীদের ফিলিস্তিন প্রবেশের ১৪০০ বছর পূর্বে তারা আগমন করে।
আমোরীয়রা ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আরেকটি সম্প্রদায়। তাদের থেকেই এসেছে হেকসোস সম্প্রদায়। তাদের কয়েকশ বছর পর ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ব্লেস্ট জনগোষ্ঠী। তারা এসেছিল ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রিট থেকে। এরাও ইহুদী ছিল না। তারা এ অঞ্চলের নাম রেখেছিল বালিস্তিন। সেখান থেকেই পরিবর্তন হয়ে ফিলিস্তিন হয়েছে।
ব্রোঞ্জ যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫৫০) ফিলিস্তিনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ যুগেই এখানে ইবরাহীম আ.-এর মাধ্যমে প্রথম তাওহীদের প্রকাশ ঘটে। যখন তিনি ইরাক থেকে হিজরত করে (খ্রিস্টপূর্ব-১৯০০) ফিলিস্তিনে আসেন তখন ছিল হেকসোসদের শাসনামল। নুহ (আ.)-এর জমানায় প্লাবনে সব ধ্বংস হওয়ার পর তার মাধ্যমেই ফিলিস্তিনে তাওহিদের প্রদীপ নতুন করে প্রজ্বলিত হয়। তিনি ও তার স্ত্রী সারা (আ.) খ্রিষ্টপূর্ব উনিশ শতকে ইরাক থেকে ফিলিস্তিনে আগমন করেন এবং জেরুজালেমে একটি উপাসনালয় গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে ‘বাইতুল মাকদিস’ নামে পরিচিতি লাভ করে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ছেলে ইসহাক (আ.) সহ তার বংশ পরম্পরায় এ পবিত্র ভূমির পরিচর্যা করেন। হজরত ইসহাক (আ.)-এর সন্তান ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। তবে পরবর্তীতে তিনি তুরস্কে হিজরত করেন। কয়েক বছর পর আবারো তিনি ফিলিস্তিনে আগমন করেন। ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ইসরাইল (আ.)। তার বংশধরকেই বনি ইসরাইল বলা হয়। ফিলিস্তিনে তখনো হেকসোসদের শাসন চলছিল। এক সময় সম্রাট আহমোস ফিলিস্তিনে হামলা করলে হেকসোসরা পরাজিত হয়। আর সম্রাট আহমোস বনি ইসরাইলকে মনে করে হেকসোসদের সহযোগী। তাই তাদের ওপর নেমে আসে প্রচণ্ড জুলুম ও নির্যাতন। এ অত্যাচার চলে প্রায় তিনশত বছর পর্যন্ত। অবশেষে তারা অতিষ্ঠ হয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করে মিশরের সিনাই উপত্যকায় আসে। আর সেখানে ছিলেন হজরত মুসা ও হারুন (আ.)। আল্লাহর নির্দেশে হজরত মুসা (আ.) খ্রিষ্টপূর্ব ১২৫০ সালের দিকে বনি ইসরাইলকে নিয়ে বাইতুল মাকদিসে রওয়ানা হন। তবে সেখানে অত্যাচারী কেনআনিদের বসবাস থাকায় বনি ইসরাইল শহরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় তারা তীহ প্রান্তরে পাগলের মতো ঘুরতে থাকে। তীহ প্রান্তরে থাকা অবস্থায়ই হজরত মুসা (আ.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পরে বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের ভার আসে হজরত ইউশা (আ.)-এর ওপর। ইউশা (আ.) হচ্ছেন মূসা (আঃ) এর সাহাবীদের মধ্যে প্রথম প্রজন্মের একজন। তিনি ছিলেন ইউসুফ (আঃ) এর বংশধর। তওরাতের কিছু বাণী আছে এমন একটি গ্রন্থ ‘বাইবেল’ এ তিনি নবী হিসেবে উল্লেখিত আছেন। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ শতাব্দীতে বনি ইসরাইলদের নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। তখন কেনআনিদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে বনি ইসরাইল বিজয় লাভ করে এবং ইউশা (আ.) তাদের নিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করে। তার জীবদ্দশায়ই বনি ইসরাইল অনেক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। একসময় হজরত ইউশা (আ.) ইন্তেকাল করেন। আর তাদের মাঝে ছড়িয়ে পরে পৌত্তলিকতা।
খ্রিষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীর শেষে শাওল ইবনে কায়স (তালুত) বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। তখন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। তাদের সেনাপতি ছিল জালুত। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হজরত দাউদ (আ.) জালুতকে হত্যা করেন। হজরত দাউদ (আ.) ফিলিস্তিনে ৪০ বছর শাসন করেন। তার ইন্তেকালের পরে হজরত সুলায়মান (আ.) বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বেশ দাপটের সাথেই শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তার প্রভাবে ইসরাইলিরা নুইয়ে পড়ে। তিনি জীনদের দ্বারা বাইতু‘ল মাকদিসকে সংস্কার করেন। সুলায়মান (আ.)-এর ইন্তেকালের পরে মিশরের সম্রাট শিশাংক খ্রিষ্টপূর্ব ৯২০ সালে উত্তর অঞ্চলের ওপর হামলা করে দখল করে নেয়। আর ৭২১ সালে আ্যসিরিয়ানরা দক্ষিণ অঞ্চলের ওপর আক্রমন করে দখল করে নেয়। আর ধ্বংস হয়ে যায় ২০০ বছরের ইসরাইলি সাম্রাজ্য।
শিশাংক ও আ্যাসিরিয়ানদের আক্রমণে ইহুদি সম্প্রদায়ের কোমর ভেঙ্গে যায়। তবে ইহুদিদের ইয়াহুযা সম্প্রদায় ভাঙ্গা কোমর নিয়ে আরো ১৫০ বছর মাকদিস শাসন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ইরাকের সেনাপতি বুখতে নসর আবারও তাদের ওপর তাণ্ডবলীলা চালায়। ধ্বংস করে মসজিদে আকসা। বন্দি হয় প্রায় ৪০ হাজার ইহুদি। আর চিরতরে অবসান ঘটে ইহুদিবাদি সাম্রাজ্যের। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের শাসনকাল ছিল মোট ৪১৮ বছর। যার মধ্যে সুলায়মান (আ.) ৮০ বছর ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে শাসন করে। আর বাকি ৩৩৮ বছর ছিল ফিতনা -ফ্যাসাদ ও জুলুমণ্ডনির্যাতনে জর্জরিত। আর ইহুদিরা এ শাসনকেই বুনিয়াদ বানিয়ে এ দাবি তুলছে, যে তারাই ফিলিস্তিনের বেশি হকদার।
রোমান সেনাপতি আলেকজেন্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে পারসিকদের পরাজিত করে। ইহুদিরা পারসিকদের থেকে ভালো সুবিধা না পাওয়ায় রোমানদের যুদ্ধে সার্বিক সহোযোগিতা করে। এমনকি কোনো কোনো ইহুদি রোমানীয়দের ধর্মও গ্রহণ করে। রোমানরা ফিলিস্তিন বিজয়ের পর সর্বপ্রথম তাকে রোমের অধীনে নিয়ে আসে। ফিলিস্তিনে রোমানীয়দের শাসনকালেই ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। হজরত ঈসা (আ.)-এর ইন্তেকালের প্রায় ১০০ বছর পর আবারও শুরু হয় ইহুদিদের বিদ্রোহ। ১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বারবুখা-এর নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের আক্রমণে ইহুদিরা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। আর হাদ্রিয়ানের সেনাবাহিনী দখলে নেয় আল কুদসের পুরো ইহুদি অঞ্চল। চালায় ধ্বংসলীলা। এ ঘটনার পর থেকে ইহুদিরা আর কখনোই বিদ্রোহের চেষ্টা করেনি। তখন থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আল-কুদস রোমানদের অধীনেই থাকে।
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ চলছিল হজরত উমর (রা.) খেলাফত কাল। মুসলিম বাহিনীর ইয়ারমুক বিজয়ের কারণে গাজা, নাবলুস, লদ, ইয়াফা ও রাফাহসহ কুদসের অন্যান্য অঞ্চলও বিজিত হয়। আল কুদসের অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে রোমান খ্রিষ্টানরা। দীর্ঘ ৪ মাস অবরোধের পর মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হন। তখন জেরুজালেমের বিশপ সফরোনিয়াস উমর (রা.) কাছে কুদসের চাবি প্রদানের শর্তারোপ করেন। অতঃপর উমর (রা.) নিজে ফিলিস্তিনে আগমন করেন এবং খ্রিষ্টানদের সঙ্গে নিম্ন লিখিত দু’টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন- এক. খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন গির্জাঘর ও উপাসনালয় নিরাপত্তা পাবে। দুই. এই পবিত্র শহরে কোনো ইহুদি বসবাস করতে পারবে না। সেই ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র ‘আহদিয়ায়ে উমরিয়্যাহ’ নামে বিখ্যাত।
হজরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) ছিলেন শামের প্রথম মুসলিম গভর্নর। তার ইন্তেকালের পর গভর্নর হন মুআয ইবনে জাবাল (রা.)। তার ইন্তেকালের পর গভর্নর হন ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.)। তার ইন্তেকালের পর গভর্নর হন মুআবিয়া (রা.)। হজরত মুআবিয়া (রা.) হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খেলাফত। সেই সময়টা ছিল ফিলিস্তিনিদের উন্নতি ও অগ্রগতির বসন্ত কাল। ১২৯ হি: ভূমিকম্পে মসজিদে আকসার বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন উমাইয়া খলিফার নেতৃত্বে দ্রুত মসজিদটির মেরামত করা হয়। ১৩২ হি: উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামের তৃতীয় খেলাফত আব্বাসী যুগ (১৩২-৬৬৫ হি:)। তাদের শাসন কার্য ২৪৭ হি: দুর্বল হয়ে পড়ে। আব্বাসীয়দের দুর্বলতাকে কাজে লাগায় উবায়দিয়রা। তারা ছিল নিকৃষ্ট শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। উবায়দিয়াদের দখলের মধ্য দিয়ে এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে ফিলিস্তিন। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দাওয়াতের কার্যক্রম একেবারে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। তবে ৪৬৩ হি: সুলতান আল্প আরসালানের নির্দেশে তুর্কি সেনাপতি আতসিয ইবনে উবাক উবায়দিয়াদের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের উদ্ধার করে। কিন্তু সামান্য ভুলের কারণে ৪৮৯ হি: উবায়দিয়ারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং ফিলিস্তিন দখল করে।
৪৯০ হিজরিতে উবায়দিয়াদের শাসন আমলে ধেয়ে আসে ক্রসেডারা । দ্বিতীয় পোপ আরবান ক্রসেডরদের উদ্দেশে এক জালাময়ী বক্তৃতা দেয়। যা সমগ্র ইউরোপে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে আবেগী কণ্ঠে বলে ‘মহামতি মসিহের সমাধি মুসলমানদের থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাদের হাত থেকে আল কুদসকে পবিত্র করতে হবে’। যার ফলে পিটার আন নাসিক এর নেতৃত্বে ক্রসেডররা ফিলিস্তিনে হামলা করে এবং তারা ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কুদস আঙ্গিনায় প্রবেশ করে ৭০ হাজার মুসলমানকে জবাই করে কুদস শহরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। ক্রসেডারদের শাসনামলে বাইতুল মাকদিস ছিল ল্যাটিন সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। ক্রসেডারা ৫৬৫ (হি.) পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত বছর ফিলিস্তিন শাসন করে।
মহাবীর সালাহ উদদ্দিন আইয়ুবীর সঙ্গে ৫৮৩ হিজরিতে ক্রসেডারদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ইতিহাসে হিত্তিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুসলমানগণ এ যুদ্ধে বিজয়ী হলে কুদস দখলের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলমান সৈন্যদল ৫৮৩ হিজরির ১৫ রজব থেকে টানা ১২ দিন বাইতুল মাকদিস অবরোধ করেন। অবরোধ শেষে ২৭ রজব আল কুদসের ওপর মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। ৫৮৩ হিজরি থেকে নিয়ে ১৩৩৫ হিজরি পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসে চলে মুসলমানদের সোনালি যুগ। উসমানীয় সাম্রাজ্য চলাকালে মোনাফেক মুসলমান ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্রে বাইতুল মাকদিসের পতনের যাত্রা শুরুহয়। আর সেই ধারাবাহিতায় ইহুদিরা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে প্রায় সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিন ব্রিটেন বিরোধী জোটে ছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার চুক্তিতে যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতা কামনা করে। আর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি তাই স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা মুসলমানদের অনুকূল বলেই ধরে নেয় স্থানীয় আরবীয়রা। তবে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান বোমার কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করে ব্রিটেনকে উপহার দেয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আনন্দিত হয়ে এই ইহুদি বিজ্ঞানীর কাছে জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? সে উত্তর দিয়েছিল- অর্থ বা সম্পদ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি চাই, আর তা হবে ‘ফিলিস্তিন’। অতঃপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন বিজয়ী হওয়ার পর ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেওয়ার নামে ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের শোষণের অধীনে রাখে। যা ছিল ফিলিস্তিনকে আরব বিশেষত মুসলিম শূন্য করার এক অভিনব প্রক্রিয়া। ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন সদস্য লিওনেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে সম্বোধন করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটি ছিল মাত্র ৬৭ শব্দের। কিন্তু এর তাৎপর্য এত বেশি তা এখনো ধারণ করতে হচ্ছে পৃথিবীকে। এই চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারকে ‘ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় বাসস্থান প্রতিষ্ঠা’ ও তার ‘অর্জন’ সহজতর করার কথা উল্লেখ ছিল। আর এই চিঠিটিই ইতিহাসে দদবেলফোর” ঘোষণা নামে পরিচিত।
বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী শক্তিগুলো পরাভূত। অপর দিকে ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার আশায় ক্ষণ গুনে গুনে তদবির চালাচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা মুসলমানদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে ‘জাতিপুঞ্জ’ ঘোষণার মাধ্যমে ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে বিভিন্নদেশে বসবাসরত ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিন আসতে শুরু করে এবং ইহুদিবাদী তিনটি প্রধান সংগঠন হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় মুসলিম নারী-পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে বাড়িতে লুটতরাজ চালায়। যাতে করে আরবীয়রা ফিলিস্তিন ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল, তখন পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে ফিলিস্তিনি বন্দরে ভিড়তে চাওয়া দু’টি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা ধ্বংস করে এবং জাহাজে থাকা ১০৪৫ জন ইহুদিকে হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে ব্রিটিশদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে।
১৪ মে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হবার কথা। ইহুদি-ব্রিটিশের জোর লবিং বিষয়টিকে নিয়ে যায় জাতিসংঘে। আর ব্রিটিশ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন নিয়ে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ প্রস্তাব পাশ করে। প্রাচীন ফিলিস্তিন ভেঙ্গে তৈরি হয় ফিলিস্তিন ও ইসরাইল। ভারত, পাকিস্তান ও ইরান এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কানাডা, চেকোস্লাভাকিয়া, পেরু, গুয়েতেমালা, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা ও উরুগুয়ে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার পক্ষে প্রস্তাব দেয়। মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ৫৭% ভূমি পায় ইহুদিরা। আর ৪৩% পায় ফিলিস্তিনিরা। এভাবেই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল নামে একটি অবৈধ রাষ্ট্র। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের এধরণের ভাগ করে দেওয়ার এ পরিকল্পনা কোনো আরব দেশ মেনে নেয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, ইহুদিরা জনসংখ্যায় কম হলেও তাঁদের বেশি ভূখণ্ড দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনাটিতে।
জাতিসংঘের রায়ের পর আরবীয়রা গাজা নামক শহরের উপকণ্ঠ উত্তর-দক্ষিণে বসবাস শুরু করে। আর ইহুদিরা ফিলিস্তিনের উত্তর-পশ্চিমে বসবাস করতে শুরু করে। যেহেতু উত্তর-পশ্চিমের তাদের বসবাসের সীমানা নির্ধারিত ছিল না, তাই তারা মুসলমানদের সেখান থেকে সমূলে বিতাড়িত করে ভূখণ্ড দখলের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতি করত। কখনো কখনো পানি, গ্যাস ও বিদ্যুত লাইন বন্ধ করে রাখত। যার ফলে অসংখ্য আরবীয়রা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন ও মিশরে পাড়ি জমিয়েছিল। কিছুদিন পরেই ইহুদি জায়নবাদীদের প্রধান দাভিদ বেন গুরিয়নকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে ১৯৪৮ সালের ১২ মে সাথে সাথেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ধাপে ধাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার পরদিন ইসরায়েলকে আক্রমণ করে পাঁচ আরব দেশের সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের কাছে এ যুদ্ধ হয়ে ওঠে স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসেবে। ১৯৪৯ সালে এক অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তবে ইতিমধ্যে ইসরায়েল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। অস্ত্রবিরতি চুক্তি অনুযায়ী মিসর গাজা উপত্যকা, জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এর আগে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি আরব বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান বা তাঁদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের বাড়িঘরে বসতি গড়েন ইহুদিরা। এদিকে, বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ ফিলিস্তিনি হয়ে যান শরণার্থী। পরবর্তী বছরগুলোয় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম–অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে হাজার হাজার ইহুদি ইসরায়েলে পাড়ি জমান।
১৯৬৭ সালের ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় যা ‘সিক্স–ডে ওয়ার’ নামেও পরিচিত। এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা বদলে দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ইসরায়েলের সঙ্গে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডান। মিসর ও সিরিয়ার কাছে থেকে হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় ইসরায়েল আগবাড়িয়ে মিসরের বিমান বাহিনীর ওপর হামলা চালালে এ যুদ্ধ বাধে।
যুদ্ধে মিসরের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমির বেশির ভাগ এবং জর্ডানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর দখল করে নেয় ইসরায়েল। এর ফলে পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ইসরায়েল ১৯৭৯ সালে মিসরের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করে এবং সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেয়। তবে ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান মালভূমিকে পাকাপাকিভাবে তাদের অংশ করে নেয়।
মিশরের ইসলামি রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড। দখলদার ইসরাইলিদের কাছে বাস্তুচ্যুত অনেক ফিলিস্তিনি মিশরে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ব্রাদারহুডের আদর্শে দীক্ষা নেন। ১৯৮৭ সালে এমনই দুজন আহমেদ ইয়াসিন ও আব্দেল আজিজ আল-রানতিসি প্রতিষ্ঠা করেন হামাস। হামাস হচ্ছে, হারকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া- এর সংক্ষেপ, যার অর্থ ইসলামি নবজাগরণের আন্দোলন। হামাসের দু’টি সংগঠন রয়েছে। এর একটি সাংস্কৃতিক, যার নাম দাওয়াহ। আর অপর সামরিক শাখার নাম ইজ্জ আদদ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেডস। ১৯৮৭ সালে হামাসের আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয় যা আজও চলমান। তারা মুক্তিকামী যোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধে মরণজয়ী হয়ে ইসরাইলের জুলুমের প্রতিবাদ করে চলেছে নিরন্তর। এই মুজাহিদ বাহীনির দ্বারাই হয়ত আল্লাহ বাইতুল মাকদিসকে আবারও মুসলমানদের হস্তগত করবেন- ইনশাআল্লাহ।
[মোঃ বিল্লাল হোসেন জুয়েল, শিক্ষক, সংবাদিক ও গবেষক ইমেইল-ংঁহ.নযড়ষধ.নফ@মসধরষ.পড়স]
আপনার মতামত লিখুন :