ভ্রমণ মানেই নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা, আর জীবনের এক ভিন্ন স্বাদ। তবে সবার জন্য ভ্রমণ কেবল আনন্দের নয়। অনেকের জন্য ভ্রমণের আগেই বুক ধড়ফড় করা, ঘুম না হওয়া, কিংবা যাত্রাপথে অজানা আতঙ্কে পেয়ে বসা খুব স্বাভাবিক। এটাকেই বলা হয় ভ্রমণজনিত উদ্বেগ বা ‘ট্রাভল অ্যাংজাইটি’।
মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘অ্যান্টিসিপেটরি স্ট্রেস’ বা পূর্বাভাসজনিত চাপ। অর্থাৎ, ভ্রমণের আগে বা চলাকালীন দুশ্চিন্তা, ভয় কিংবা চাপ তৈরি হওয়া।
‘আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ)’ জানায়- নতুন জায়গায় যাওয়া, ভিন্ন রুটিন, কিংবা ভিড়ভাট্টা মানুষের মধ্যে উদ্বেগকে বাড়িয়ে তোলে।
তামারা লেভিট, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় মেডিটেইশন বিশেষজ্ঞ এবং ‘কাম’ অ্যাপের নির্দেশক, তিনি কাম ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, “ভ্রমণ স্নায়ুতন্ত্রকে অজানা অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়। এতে শরীর স্বাভাবিকভাবেই সতর্ক হয়ে ওঠে, যা উদ্বেগের রূপ নেয়।” অর্থাৎ, ‘ট্রাভল অ্যাংজাইটি মানেই অসুস্থতা নয়, বরং শরীর ও মনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
লক্ষণগুলো যেমন হতে পারে
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্রমণের উদ্বেগ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মধ্যে ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা নেতিবাচক চিন্তা: ভ্রমণে অসুস্থ হওয়া, ট্রেন বাস বা ফ্লাইট মিস করা কিংবা ভয়ানক কিছু ঘটবে এই চিন্তা ঘুরতে থাকে।
শারীরিক টানটান অবস্থা: দাঁত চেপে ধরা, কাঁধ শক্ত হয়ে যাওয়া।
পেটের সমস্যা: বমিভাব, হজমে গোলমাল, ক্ষুধামান্দ্য।
অস্থিরতা ও খিটখিটে মনোভাব: অজানা পরিবেশে অস্বস্তি।
ঘুমের সমস্যা: যাত্রার আগের রাতে ঘুম না আসা।
এড়িয়ে চলা: ব্যাগ গোছানো পিছিয়ে দেওয়া বা ভ্রমণ বাতিল করা।
আতঙ্কের আক্রমণ: ভিড় বা বিমানবন্দরের মতো জায়গায় হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
যে কারণে হয় ট্রাভল অ্যাংজাইটি
ভ্রমণজনিত উদ্বেগ সাধারণত একাধিক কারণে তৈরি হয়।
অজানার ভয়: নতুন জায়গা বা অপরিচিত রুটিন মানসিক চাপে ফেলে।
পূর্বের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা: অতীতে ভ্রমণে দুর্ঘটনা, ফ্লাইট মিস বা জটিলতা থাকলে মস্তিষ্ক আবারও সেটি আশঙ্কা করে।
স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা চিন্তা: অসুস্থ হয়ে পড়া বা বিপদের আশঙ্কা।
ইন্দ্রিয়ের অতিরিক্ত চাপ: বিমানবন্দরের ভিড়, শব্দ বা ডিজিটাল ক্লান্তি।
চাপের আনন্দ: ছুটি বা ভ্রমণকে নিখুঁতভাবে উপভোগ করার চাপও উদ্বেগ তৈরি করে।
সামলে নেওয়ার উপায়
আগে থেকে প্রস্তুতি: অযথা নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা না করে মৌলিক জিনিসের তালিকা বানাতে হবে। পাসপোর্ট, ওষুধ, টিকিট, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র গোছাতে হবে। যাত্রার আগের দিন কিছুটা ফাঁকা রাখা উচিত, যাতে তাড়াহুড়ো না হয়।
তামারা লেভিট, ভ্রমণের আগে মেডিটেশন শোনার পরামর্শ দেন। বিশেষ করে যারা বিমানে উঠতে ভয় পান।
স্বস্তির জিনিস সঙ্গে রাখা: পরিচিত সংগীত শোনার জন্য হেডফোন, ভ্রমণ আকারের কম্বল, ভেষজ চা— এসব মানসিক শান্তি দেয়। হোটেলে পৌঁছে কিছুটা স্ট্রেচিং করলে শরীরও হালকা হয়।
যাত্রাপথ সহজ করা: প্রতিদিন একাধিক কাজের তালিকা না বানিয়ে একটি পরিকল্পিত কাজ রাখতে হবে। বাকিটা সময় চাপমুক্ত থাকা জরুরি।
প্রয়োজনে ভ্রমণ সঙ্গীদের জানান যে, বিকেলে বিশ্রাম নেব বা আগামীকাল সকালে ধীরে শুরু করব। ভ্রমণের সময় সীমানা তৈরি করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।
প্রত্যাশা সামলে নেওয়া: প্রত্যেকটি মুহূর্ত নিখুঁত হবে না। এটা মেনে নিতে হবে। অনেক সময় ভ্রমণ ঝামেলাপূর্ণ হয়, আর সেটি স্বাভাবিক। নিজের ও সঙ্গীর কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে।
শরীর ও মনকে স্থির করা: উদ্বেগ বাড়লে ৫–৪–৩–২–১ কৌশল ব্যবহার করা যায়। পাঁচটি দেখার জিনিস, চারটি স্পর্শ করা যায় এমন জিনিস, তিনটি শোনা যায় এমন শব্দ, দুটি গন্ধ, একটি স্বাদ এসব মনে করে নিজেকে বর্তমান মুহূর্তে ফেরাতে হবে।
এছাড়া ধীরে শ্বাস নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লে স্নায়ু শান্ত হয়।
প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বেগ কমাতে সামাজিক সমর্থন কার্যকর। তাই যাত্রার আগে বা চলাকালীন ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সম্ভব না হলে ডায়েরিতে অনুভূতি লিখে রাখা যায়।
নিজেকে সহানুভূতি দেওয়া: উদ্বেগ মানেই শরীর নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছে। তাই আতঙ্ক আসলে নিজেকে বলতে হবে- এভাবে অনুভব করা স্বাভাবিক। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কারণ আত্ম-সহানুভূতি মানসিক চাপ কমানোর অন্যতম বড় উপায়।
ভ্রমণ উদ্বেগ কি স্বাভাবিক?
ভ্রমণ উদ্বেগ খুবই সাধারণ। এটি কোনো অসুখ নয়, বরং অপরিচিত পরিবেশ ও রুটিনের কারণে সৃষ্ট মানসিক প্রতিক্রিয়া।
আপনার মতামত লিখুন :