Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫, ১১ কার্তিক ১৪৩২

কুঁশিকাটায় জীবনের জয়গান: লিজা এখন অর্ধশত নারীর প্রেরণা


দৈনিক পরিবার | মুহা. জহিরুল ইসলাম অসীম অক্টোবর ২৬, ২০২৫, ০৮:৩৬ পিএম কুঁশিকাটায় জীবনের জয়গান: লিজা এখন অর্ধশত নারীর প্রেরণা

নেত্রকোণা সদর উপজেলার পঁচাশিপাড়া গ্রামের আফরোজা আক্তার লিজা এখন অনুপ্রেরণার এক নাম। একসময় সংসারের টানাপোড়েন, অবহেলা আর নিপীড়নের শিকার এই নারী আজ অর্ধশতাধিক অসচ্ছল নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছেন। জীবনের কঠিন বাস্তবতা জয় করে তিনি গড়ে তুলেছেন “লিজা বুটিকস হাউজ” নামের প্রতিষ্ঠান।
২০০৩ সালে এসএসসি পাস করার পর পারিবারিক অনীহায় লিজা আর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। ২০০৭ সালে তার বিয়ে হয়। সংসারে সুখের আশা ছিল, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। স্বামীর মাদকাসক্তি, অবহেলা ও নির্যাতনের কারণে আট বছর পর এক সন্তানকে নিয়ে তাকে বাবার বাড়ি ফিরে আসতে হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম।
বাবার বাড়িতে ফিরে লিজা পুরনো পরিচিত সুঁই-সুতার কাজ নিয়েই নিজের নতুন পথচলা শুরু করেন। তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বিসিক থেকে বাটিক, সেলাই, বিউটিফিকেশনসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শিশুদের জামা তৈরির কাজ শুরু করেন। দোকানে দোকানে পণ্য সরবরাহ করে ধীরে ধীরে আয় বাড়তে থাকে।
লিজা নিজে যেমন আত্মনির্ভর হয়েছেন, তেমনি তার মতো সংগ্রামী অনেক নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করেছেন। তারা বাড়িতে বসেই পণ্য তৈরি করে সরবরাহ করেন লিজার কাছে। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ৫০ জনেরও বেশি নারী কাজ করছেন।
২০২৩ সালে তিনি শহরের শিববাড়ি এলাকায় ুলিজা বুটিকস হাউজ” নামে সেলস সেন্টার চালু করেন। এখান থেকেই তার তৈরি কুঁশিকাটার পোশাক ও হস্তশিল্পের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। লিজার তৈরি পণ্য এখন বিদেশেও যাচ্ছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে তার বুটিকস হাউজের সামগ্রী।
লিজার সঙ্গে কাজ করা কামরুন্নাহার বাবলী বলেন, লিজা আপার সঙ্গে কাজ শুরু করার পর আমার জীবন বদলে গেছে। এখন নিজের উপার্জনে সংসার চালাতে পারি, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ দিচ্ছি।
আরেকজন কর্মী মিনা বেগম বলেন, অভাবের সংসারে লিজা আপা আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন আমি মাসে মাসে কিছু টাকা আয় করি। সংসারে শান্তি ফিরেছে।
এভাবেই বাবলী, মিনা, ডলি, রুণা, কাঞ্চন, শিউলীসহ অর্ধশত নারী লিজার হাতে বদলে ফেলেছেন তাদের জীবন।
লিজা বলেন, স্বামীর সংসারে যখন টিকতে পারিনি, তখন বুঝেছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। ছোটবেলায় শেখা সেলাই-কুশিকাটার কাজই আমার ভরসা হয়। সরকারি দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করি। অন্য নারীদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করি। এখন অনলাইন ও অফলাইনে আমার পণ্য বিক্রি হয়। দেশের বাইরেও যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমি চাই, শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি বড় শোরুম করতে এবং নিজস্ব কারখানা গড়ে তুলতে। সরকারের সহযোগিতা ও সহজ ঋণ পেলে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
লিজা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও নারীদের পাশে আছেন। তার সঙ্গে কাজ করা নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, সন্তানদের শিক্ষা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে তিনি নিয়মিত কাজ করেন।
জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফারজানা পারভীন বলেন, লিজা যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন। নিজের চেষ্টায় তিনি যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থান দিয়েছেন। সমাজে এমন নারীই পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত।
আজ আফরোজা আক্তার লিজা শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, তিনি নারীর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তার হাতে বোনা কুঁশিকাটা এখন হয়ে উঠেছে আশার প্রতীক যেখানে প্রতিটি সুতায় জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সাহস ও সফলতার গল্প।

Side banner