ছয় বছরে নির্মাণ হয়নি মোল্লাবাজার সেতুর। কচ্ছপ গতিতে চলছে সেতুর কাজ। উত্তর পাশের স্থলভাগের ৫টি পিলারের কাজ এখনও শেষ হয়নি। সেতুর নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে তাও কেউ বলতে পারছে না।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের মোল্লাবাজারস্থ ধলেশ্বরীর শাখা নদীতে ২৫২ মিটারের সেতু নির্মাণে ইতোমধ্যে কেটে গেছে ছয় বছর। একটি মাত্র সেতু মুন্সীগঞ্জের ৪ উপজেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যানজটবিহীন দ্রুত যাতায়াত নিশ্চিত করতে পারে। শুধু মুন্সীগঞ্জ নয় এই সুবিধা পাবে নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের এবং কেরানীগঞ্জের বড় একটি এলাকা।
২০২২ সালে জুনে তৃতীয়বারের মতো সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৪ সালের জুন মাসে এসে কাগজে কলমে কাজ শেষ হয়েছে ৭০ ভাগ। এখন আবার তিন মাস ধরে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে মূল সেতু নির্মাণ কাজ। এই ব্রিজ থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে রাস্তার ওপরে নির্মাণ হয়েছে আধুনিক এলিভেটেড কেরানীগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন। এছাড়া এই সেতু ব্যবহার করে সহজে ঢাকায় যেতে ১৫ বছর আগেই নির্মাণ করা হয়েছিল ১৬ কিলোমিটার পিচ ঢালাই সড়ক। কিন্তু সেতুটির নির্মাণ কাজ ৪ বছর আগে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজের প্রায় অর্ধেকটাই বাকি।
রাজধানীর সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের চার উপজেলার যোগাযোগ সহজ করতে সিরাজদিখান উপজেলা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখা নদীর ওপর ২০১৮ সালে ২৫২ মিটার সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো। চারটি উপজেলার মানুষের আশার এ সেতুর নির্মাণ সময় মত কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় কয়েক দফা সময়ও বাড়ানো হয়েছিল। তারপরও সম্ভব হয়নি। সময় মত কাজ শেষ করতে না পারার বিষয়ে এলজিইডি ও ঠিকাদারের লোকজন একে অপরকে দোষারোপ করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এ সেতুর কাজ কবে শেষ হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এ পথে যাতায়াতকারীরা।
কেরানীগঞ্জ এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৩ খুঁটির ওপরে ১২ স্প্যান বসিয়ে নির্মাণ করা হবে ২৫২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৮ মিটার প্রস্থের সেতুটি। সুরমা এন্টারপ্রাইজ নামে রাজধানীর এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময় মত কাজ শেষ না হওয়ায় কাজের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত করা হয়। ২০২৪ সালেও এসেও কাজটি শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার।
কেরানীগঞ্জ এলজিইডি উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শওকত আলী বলেন, সেতুর কাজ ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের গাফলতির কারণে সময় মত কাজ শেষ করতে পারেনি। এজন্য গত দুমাস আগে সুরমা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে চুক্তিবাতিল করা হয়েছে। অবশিষ্ট কাজের জন্য ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে নতুন করে আবারো দরপত্র আহ্বান করে কাজ শুরু করা হবে।
সুরমা এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মাসুম আলী বলেন, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আমরা কাজটি করবো না বলে আত্মসমর্পণ করেছি। কাজটি না করায় এক কোটি টাকা জরিমানা গুণতে হবে। নির্মাণ সামগ্রীর চওড়া দাম। কাজটি করতে গেলে চার কোটি টাকা লোকসান হত। কাজটি সময় মত কেন শেষ করলেন না, এমন প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এই ঠিকাদার।
পরে তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, এলজিইডির লোকজনের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা করা উচিত। প্রত্যেকের ঢাকায় বড় বড় ভবন আছে। প্রকল্পের লোকজন ও এলজিইডি সংশ্লিষ্টরা বড় বড় ঠিকাদারি কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার সুবিধা নেয়। যাদের কাছে সুবিধা পায় তাদের কাজের টাকা আগে দেয়। আমাদের টাকা আটকে রাখতো। এজন্য আমরা কাজ চালিয়ে যেতে পারিনি। আমাদের কোনো গাফলতি ছিলনা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন মূল সেতুর ৮ টি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। পিলারের ওপর দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড়েও তিনটি পিলারে দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে। তবে নদীর মধ্যখানে নির্মাণ করা পিলার দুটি এমনি পড়ে আছে। নদীর দক্ষিণ প্রান্ত নির্মাণ সামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসব পাহারায় রয়েছেন সুরমা এন্টারপ্রাইজের পাহারাদার নিমাই শাহা।
তিনি বলেন, ১৩ টি খুঁটির মধ্যে মূল সেতুর ৮ টি খুঁটি আমরা করেছি। আমাদের কোম্পানিকে ঠিকমতো টাকা দেয়া হতো না। তাই আমরা কাজ ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের কিছু মালামাল আছে। আমি সেগুলো পাহারা দিচ্ছি।
এই সেতুর সড়কে জেলা সদর, টঙ্গীবাড়ি, লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলার যাতায়াতের জন্য বেতকা চৌরাস্তা হতে সিরাজদিখানের মোল্লা বাজার হয়ে ব্রিজের গোড়ার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার সেখান থেকে ঢাকার পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত সড়কপথে দূরত্ব ৬ কিলোমিটার যা অতিক্রম করতে সময় লাগে যানজটবিহীন ৩০ মিনিট। অথচ সিরাজদিখান হয়ে অপর সড়কে ঢাকা- মাওয়া হাইওয়ে দিয়ে ঢাকার দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। আর যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। আরো দুটি পথ রয়েছে ঢাকা যেতে তা হলো নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া দিয়ে অপরটি পাগলা দিয়ে দুটি পথেই অসহনীয় যানজট। মুন্সীগঞ্জ থেকে ৩ ঘণ্টার আগে ঢাকা যাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। তাই মোল্লাবাজার সেতুটি নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ না হওয়ায় দুই পারের লাখ লাখ মানুষ সহজে ঢাকা যেতে ঝুঁকি নিয়েই ট্রলার কিংবা দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত ফেরি দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছে। নির্মাণাধীন সেতুর ঠিক পূর্ব পাশ দিয়ে ছোট একটি ফেরিতে গাদাগাদি করে মুন্সীগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান, লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার মানুষেরা ঢাকায় যাতায়াত করছেন।
আপনার মতামত লিখুন :