জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুত হচ্ছে মাঠ প্রশাসন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও চলছে পরিবর্তন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কমিশনের (ইসি) পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো নির্বাচন কর্মকর্তা কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে বদলি না করতে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) পাঠানো হয়। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদলের প্রস্তুতি চলছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হবে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সই করা ওই ডিও লেটারে বলা হয়, তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, পদায়ন বা ছুটি প্রদানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সম্মতি নিতে হবে।
সংবিধানের-১২৬ অনুচ্ছেদ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশ্লিষ্ট ধারার আলোকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এরপর ১৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন গণভোট ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী এলাকা, ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, নির্বাচনী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জেলার বাইরে বদলির আদেশ স্থগিত সম্পর্কিত পরিপত্র জারি করে।
নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রের ‘নির্বাচনী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জেলার বাইরে বদলির আদেশ স্থগিতকরণ’ অংশে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ৪৪৬ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের সাথে পূর্বালোচনা ব্যতীত, নিম্নোক্ত কর্মকর্তাবৃন্দকে স্ব স্ব কর্মস্থল হতে বদলি না করার বিধান রয়েছে। তারা হলেন- বিভাগীয় কমিশনার; উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক; মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার; ডেপুটি কমিশনার (ডিসি); সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসপি); বা সংশ্লিষ্ট [বিভাগ, জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকায় কর্মরত তাঁদের অধস্তন কর্মকর্তাকে কমিশনের সাথে পূর্বালোচনা ব্যতীত, বদলি করা যাবে না।
নির্ববাচন কমিশনের পরিপত্রের পর ১৫ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা প্রদান’ শীর্ষক পরিপত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ এবং গণভোট একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে। উল্লিখিত প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অনুরোধক্রমে সরকারের পক্ষ হতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও সম্পাদনের জন্য সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ তথা সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত অফিস/প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্য থেকে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রিজাইডিং অফিসার/সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার/পোলিং অফিসার নিয়োগ করার প্রয়োজন হবে।
সরকারি, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণের মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষককে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়াও নির্বাচনের বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করা হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবনসমূহ ভোটকেন্দ্র হিসেবে এবং প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা প্রয়োজন হবে।
নির্বাচন কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। অতীতেও তারা নির্বাচনের কাজে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদান করেছেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচন কর্মকর্তাগণের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ বলবৎ রয়েছে। এতে কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে তিনি তার উক্তরূপ নিয়োগের তারিখ হতে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না পাওয়া পর্যন্ত তার চাকরির অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রেষণে চাকরিরত আছেন মর্মে গণ্য হবেন। প্রেষণে চাকরিরত থাকাকালে নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষেত্রমত রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন এবং তিনি তার যাবতীয় আইনানুগ আদেশ বা নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবেন। প্রেষণে চাকরিরত থাকাকালে নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব প্রাধান্য পাবে। এমতাবস্থায়, সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে রিটার্নিং অফিসারের যে কোনো আইনানুগ নির্দেশ জরুরি ভিত্তিতে পালনের নিশ্চয়তা বিধান করা প্রয়োজন।
পরিপত্রে আরও বলা হয়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৫ অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা প্রদান করা সকলের একটি অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ৪৪৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী নির্বাচনী সময়সূচি জারি হওয়ার পর হতে ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ব্যতীত উক্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করা যাবে না।
উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে- আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজে অর্পিত দায়িত্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে পালন করে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং অধিদপ্তর/দপ্তর/সংস্থা হতে তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অবিলম্বে নির্দেশ প্রদান; শিক্ষা মন্ত্রণালয়/প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে সরকারি, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক/শিক্ষিকাদের প্রতিও অনুরূপ নির্দেশ জারি করা; নির্বাচন পরিচালনার কাজ অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ তথা সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস/প্রতিষ্ঠান/সংস্থাসমূহকে তাদের যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্বাচনের কাজে জড়িত আছেন, নির্বাচনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ছুটি প্রদান বা অন্যত্র বদলি করা অথবা নির্বাচনী দায়িত্ব ব্যাহত হতে পারে এমন কোনো দায়িত্ব প্রদান হতে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদের পরিপত্রের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সব মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিব, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সব বিভাগীয় কমিশনার, শিক্ষার সব বিভাগ, ডিসি, ইউএনওদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে সব বিভাগ।
গত ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জন ডিসি এবং তিনজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনের বদলি, প্রত্যাহার, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ যাবতীয় বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সুপারিশ করবে। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ৯ ডিসেম্বর ৩১ জন নতুন এডিসি পদায়ন করা হয়। এর আগে ২৪৩ জন নতুন ইউএনও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি উপজেলাগুলোতে আগের কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পালন করছেন। এরআগে নভেম্বরে ৫২ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে নিয়োগের পরপরই তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ছয় ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও এডিসিদের বদলি-পদায়নের আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের আদেশ জারি করে বিভাগীয় কমিশনার।
কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গণআন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নাতীত নির্বাচন আয়োজন করা সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে প্রশাসনে আরও রদবদল হতে পারে। নির্বাচনকালীন প্রশাসন থাকবে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা পর্যায়ে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।








































আপনার মতামত লিখুন :