রঙের সঙ্গে রং মিলে নতুন রং সৃষ্টি হয়। শিল্পীর ক্যানভাস বা প্রকৃতিতেই শুধু নয়, মানুষের জীবনের রসায়নেও রং এখন গুরুত্বপূর্ণ। রঙের সঙ্গে রং মিলে নতুন রং তৈরি হওয়ার এই সূত্র মেনে বন্ধুত্বে, দাম্পত্যে কিংবা পারিবারিক সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে নতুন রসায়ন। একই রঙের পোশাক পরে অনেকেই এখন জানান দিচ্ছেন তাঁরা এক ও অভিন্ন। পাশাপাশি বসে পরিবারের তিন প্রজন্ম একই রঙের পোশাক পরে ছবি তুলেছেন এমন উদাহরণ এখন কম নয়। পোশাকের রংই যেন তাঁদের সম্পর্কের মশাল।
ভালোবাসার এমন প্রকাশ নতুন দম্পতিদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাগড়ির সঙ্গে শাড়ির কিংবা শেরওয়ানির সঙ্গে শাড়ির রং মিলিয়ে কেনার চল শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে। এরপর বিভিন্ন উৎসব ঘিরে একই রং ও নকশার পোশাক বানাতে শুরু করল দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো। ধীরে ধীরে পরিধি বেড়ে রূপ নিল ফ্যামিলি সেটে। বাবা-মা ও সন্তান এক কাপড়ে ধরা দিতে শুরু করলেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। গত বছর করোনা মহামারিতে সব থমকে গেলেও ঘরের মধ্যে চলতে থাকে ম্যাচিং পোশাক পরে ছবি তোলার হিড়িক। সে সময় ফেসবুকে আপলোড করা ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন। চারদেয়ালে বন্দী সময়টা এক রকম কাপড় পরার কারণেই বর্ণিল হয়ে উঠেছিল সম্ভবত।
একটা সময় শুধু শাড়ি বা কামিজের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে চুড়ি, কানের দুল বা টিপ পরাকে বোঝানো হতো ম্যাচিং। বিজয় দিবস বা পয়লা বৈশাখ কিংবা বসন্তবরণ অথবা ভ্যালেন্টাইন দিবসে এক রকমের পোশাক পরার চল ছিল তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এখন যেকোনো পারিবারিক দাওয়াতেও পরিবারের সব সদস্যকে এক রকমের পোশাকে দেখা যায়। বর্তমানে ম্যাচিংয়ের পরিধি তাই অনেকটাই বিস্তৃত। তবে এই বিস্তার এক দিনে ঘটেনি।
সমুদ্রের পাড়ে, পাহাড়ে বা কোনো রিসোর্টে গিয়ে কয়টা দিন আরাম করার আগে অনেকেই ম্যাচিং পোশাক জোগাড়ে ঘুম হারাম করেন। সুন্দর একটি ছবির প্রথম শর্ত নান্দনিক পোশাক এ তত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। ফলে খুব দ্রুতই এই ট্রেন্ড শেষ হচ্ছে না। অন্তত করোনা ও ডেঙ্গুর হাত ধরে আসা দিনগুলোতে বিনোদনের যে আকাল, তাতে এক রঙের পোশাক পরে ছাদে গিয়ে ছবি তোলাও আনন্দের। এই আনন্দে এখন শিশুরাও শামিল। ছোটদের জন্যও এখন কাস্টমাইজড পোশাক পাওয়া যায় ফ্যাশন হাউসগুলোয়। এক ডিজাইনে সবার পোশাক বানানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে উঠেছে অনেক গ্রুপ। তারা প্রি-অর্ডার নেয় এবং চাহিদামতো পোশাক সরবরাহ করে থাকে। দিবস অনুযায়ী থিম নির্ধারণ করে অনেক ফ্যাশন হাউসও পোশাক তৈরি করছে।
এ বিষয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড কে-ক্র্যাফটের উদ্যোক্তা খালিদ মাহমুদ খান জানিয়েছেন, এক দশকেরও বেশি আগে ম্যাচিং ড্রেসের চল শুরু হয়। তখন মায়েরা মেয়েদের এক রকমের ড্রেস বানিয়ে দিতেন। ঈদের সময়ও কাজিনরা এক রকমের পোশাক বানাত। তিন-চার বছর ধরে পরিবারের সব সদস্যের অংশগ্রহণে এর প্রচলন অনেক বেড়েছে। তবে এটাকে ট্রেন্ড বলা যায় না। এক রকমের পোশাক পরলে প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীকেও সত্যিকারের জুটি বলে মনে হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই রকমের পোশাক পরলে দেখতে ভালো লাগে। এই ভালো লাগা বোধ থেকেই ম্যাচিং পোশাক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ঋতু, উৎসব, পূজা-পার্বণ কিংবা জাতীয় ও বিশেষ দিবস উপলক্ষে সিরিজ ধরে একই রকমের পোশাক বানানো হয় এখন। ফলে সারা বছর ধরে কে-ক্র্যাফটে একই রং ও মোটিফের পোশাক পাওয়া যায় বলেও জানান খালিদ মাহমুদ খান।
ম্যাচিং পোশাকের এই ধারায় শুধু যে তরুণ-তরুণীরাই যুক্ত তা নয়। এখন এটি বয়স নিরপেক্ষ হয়ে উঠেছে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যটিও সবার আগ্রহেই পরে ফেলছেন ম্যাচিং পোশাক। পারিবারিক ম্যাচিং পোশাকের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুদের আগ্রহকে।
দৃষ্টিনন্দন পোশাক হিসেবে ম্যাচিং পোশাকের যাত্রা শুরু হলেও এখন এটি সেই গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। এখন ম্যাচিং পোশাক এই যুগের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
আপনার মতামত লিখুন :