যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়ে পড়েছে। কৃষি প্রণোদনার ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার বরাদ্দ ও বিতরণে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থলোপাটের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার নেপথ্যে উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ একাধিক সরকারি কর্মকর্তার নাম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রমাণ গণমাধ্যম কর্মীদের মাঠ পর্যায়ের তদন্তে উঠে এসেছে।
এদিকে তদন্ত কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে নিশিরাতে শার্শা উপজেলার বেনাপোল সীমান্তের একটি হোটেলে গোমাংস ও রুটি খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত প্রতিবেদন কৌশলে পক্ষে নেয়ার জন্য এই গোমাংস ও রুটিভক্ষণ পার্টির আয়োজন করেছিলেন উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম।
তার নেতৃত্বে ছিলেন একাডেমিক সুপারভাইজার কামরুজ্জামান, পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্প (পজীব) কর্মকর্তা আনিসুর রহমান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জালাল আহমেদ।
পরপর দু’দিনের এই ভোজন পার্টিতে শেষ দিনে প্রণোদনা কমিটির একজন কৃষক প্রতিনিধি ও স্থানীয় একজন সাংবাদিক উপস্থিত ছিল বলে জানা গেছে।
অতিসম্প্রতি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে অপরাপর ওই পার্টিতে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ভুরি ভোজের আয়োজনের খবর ফাঁস হয়ে পড়ায় ঝিকরগাছার অফিস পাড়ায় দারুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
এদিকে কৃষি প্রণোদনার নগদ অর্থ ও উপকরণ না পাওয়ায় বঞ্চিত কৃষকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতের খরিপ-২/২০২৪-২৫ মৌসুমে রোপা আমন আবাদ প্রণোদনা কর্মসূচির ধানের বীজ ও রাসায়নিক সারসহ অর্থবছরের বিভিন্ন আবাদে বিতরণকৃত এক কোটি ৭৪ লাখ টাকার প্রণোদনা উপজেলা কৃষি বিভাগ কর্তৃক নামে-বেনামে বিতরণ, একই পরিবারে ২/৩জন, একাধিকবার একই কৃষক ও তাদের পরিবারের মাঝে বিতরণ তালিকাভুক্ত দেখানোসহ অসংখ্য অভিযোগ ধরা পড়েছে।
বঞ্চিত একাধিক কৃষকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের একটি প্রতিনিধি দল উপজেলার গঙ্গানন্দপুর, মাগুরা, শিমুলিয়া, গদখালী, পানিসারা, ঝিকরগাছা সদর, নাভারণ, নির্বাসখোলা, হাজিরবাগ, শংকরপুর ও বাঁকড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে সম্প্রতি দেয়া কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাত খরিপ-২/২০২৪-২৫ মৌসুমে রোপাআমন প্রণোদনা কর্মসূচিতে ব্যপক এই অনিয়ম ও কারচুপির সত্যতা মিলেছে।
প্রণোদনা সুবিধাভোগী তালিকায় থাকা ব্যক্তির নামের সাথে কৃষকের ছবির মিল না থাকা, মোবাইল নং ও ঠিকানায় ব্যাপক গোজামিল গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে।
প্রণোদনার এই দীর্ঘ তালিকায় সুবিধাভোগীর স্বাক্ষর একই হাতে লেখা বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। কৃষি প্রণোদনার কথিত এই তালিকায় অসংখ্য দুর্নীতি-অনিয়নের তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে তদন্তে।
রোপাআমন প্রণোদনা কর্মসূচির তালিকায় থাকা ঝিকরগাছাসদর ইউনিয়নের পদ্মপুকুর ব্লকের তালিকায় ৮১ নাম্বারে ওবাইদুল, ৮২ নাম্বারে সাহেব আলী নামের কৃষক দেখানো হলেও তাদেরও ছবির সাথে মিল পাওয়া যায়নি।
এছাড়া একই ব্লকের ৬, ৭, ৮, ৩৯, ৭১, ৭৬, ৮১, ৮২, ৮৮, ১২০, ১৩০ নাম্বারের কৃষকের নাম ঠিকানা ও ছবির মিল পাওয়া যায়নি। কৃষি প্রণোদনার তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একই ঘটনা অন্য ইউনিয়নগুলোতেও ঘটেছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কৃষি প্রণোদনার বিপুল পরিমাণ বরাদ্দকৃত অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভুপালী সরকার সুবিধাভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার আগে মাঠ পর্যায়ে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা (বিআরডিবি) পজীপ ও নাভারণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক আনিছুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।
কৃষি প্রণোদনা কমিটি ও উপজেলা বিসিআইসি অনুমোদিত ১৭ জন তালিকাভুক্ত সার ডিলারদের ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে তদন্তের জন্যে কাজ করছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কমিটির সভাপতি ভুপালি সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, বিসিআইসি অনুমোদিত ১৭জন সার ডিলারের মধ্যে মাত্র ৫জন ডিলার ঝিকরগাছা উপজেলার বাসিন্দা। বাকি ১২জন ডিলারের ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভূপালী সরকার।
এসব ডিলারদের কার্যক্রম ও জবাবদিহিতার বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসারের যোগসূত্রতা থাকলেও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কমিটির সভাপতির কোন যোগাযোগ নেই বলে জানা গেছে। অথচ অতিসম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মনোনীত তদন্তকারী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান, সার ডিলার তদন্ত কমিটির ২জন সদস্য উপজেলা প্রশাসনের অফিসারকে নিশিরাতে কৃষি অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলমের সরকারী গড়ি ব্যবহার করে বেনাপোল পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের একটি রেস্তোরায় রুটি ও গরুর মাংস খাওয়াকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তারা নিজেরা বেনাপোল পোর্টে কেনাকাটা করতে গিযেছিলেন। রাতে বেনাপোলের মার্কেট বন্ধ থাকে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সদুত্তোর দিতে পারেননি।
এব্যাপারে জানতে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একই স্টেশনে চাকরী করা একাডেমিক সুপার ভাইজার কামরুজ্জামান বলেন, পজীপ আনিছুর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তবে পজীপ কর্মকর্তা একাডেমীক সুপার ভাইজারকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তিনি ইউএনও স্যারের প্রতিনিধি হিসেবে তদন্ত করছেন সেটা আলাদা বিষয়। আর বেনাপোলে বেড়াতে যাওয়ার বিষয়টি অন্য ব্যাপার।
কী সে ব্যাপার জানতে চাইলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
আপনার মতামত লিখুন :