সারা দেশ যখন শোকে কাতর, জাতি যখন শোকে পাথর তখন অবুঝ শিশু মেহেনাজ আফরি হুমায়রার (৯) গ্রামের বাড়িতেও কান্নার রোল। স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারিতে চারদিকের আকাশ ভারি। শোকে স্তব্ধ পুরো গ্রাম। বুকের ধন মেয়ের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা সুমি আক্তার। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন। কখনো চোখ মেলে অবাক তাকিয়ে থাকছেন, আবার মুহূর্তেই মূর্ছা যাচ্ছেন। বাড়ির উঠানে আর্তনাদ করছেন বৃদ্ধা দাদি।
এদিকে সকালে জানাজা শেষে মেয়ের কপালে নয় কফিনে বারবার চুমু খাচ্ছিলেন আর কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন বাবা দেলোয়ার হোসাইন রানা। কফিনে চুমু দিয়ে বাবার অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের শেষ বিদায়ের এমন দৃশ্য যেনো দেখেনি কেউ। এমন দৃশ্য দেখে কান্না ধরে রাখতে পারেননি কেউই।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকালে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া কেরানীপাড়া হুমায়রার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এমন করুণ দৃশ্য। গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় দিয়াবাড়িতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মেহেনাজ আফরি হুমায়রার মৃত্যু হয়।
নিহত হুমায়রা ওই এলাকার দেলোয়ার হোসাইনের একমাত্র মেয়ে। দেলোয়ার হোসাইন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। তবে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দেলোয়ার হোসাইন ও তাঁর স্ত্রী সুমি আক্তার প্রাণে বেঁচে গেছেন।
শিশু হুমায়রার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বিমান দুর্ঘটনায় হুমায়রার মৃত্যুর খবরটি সোমবার বিকেলেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন সন্ধ্যার পর থেকেই গ্রামের বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন।
রাত আড়াইটার দিকে হুমায়রার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় ওই বাড়িতে কান্না ও আহাজারির শব্দে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সকলের প্রিয় ছোট্ট হুমায়রার মৃত্যু যেনো এলাকাবাসীও মেনে নিতে পারছেনা। হুমায়রার বাবা দেলোয়ার ও মা সুমি আক্তারের চোখের পানি যেনো ফুরিয়ে গেছে। পরিচিতজন বন্ধুবান্ধবদের কোনো সান্ত্বনার বাণী তাদের থামাতে পারছে না।
হুমায়রার বৃদ্ধা দাদি আহাজারি করছেন- ‘আমার বোন (নাতনি হুমায়রা) ঈদের মধ্যে বাড়িতে আইছিলো। বাড়িজুইড়্যা কতো দৌড়াদৌড়ি খেলাধুলা করলো! ওইটাই ছিল আমার সঙ্গে শেষ দেহা। এরপরে গত সপ্তাহে মাত্র একবার ফোনে কথা কইছিলাম। গত সোমবার সকালেও ফোনে কথা কইতে চাইছিলো, কিন্তু কবার পারি নাই। শেষ কথা না কইয়াই বোনে আমার চইল্যা গেল’।
হুমায়রার বাবা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক দেলোয়ার হোসাইন বলেন, হুমায়রার ছুটি হয়েছিল। তাকে বলছি- অপেক্ষা করো তোমার মা নিতে আসবে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে- আমার স্ত্রী (সুমি) শ্রেণিকক্ষের কাছে যাওয়ার আগেই ওর সামনেই বিমানটি আমার মেয়ের শ্রেণিকক্ষের ভেতর ঢুকে পড়েছে। সব ঘটনা আমার স্ত্রীর চোখের সামনেই ঘটেছে, তাকে কীভাবে সান্তনা দেবো। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানান, শহরের ভেতরে যেনো আর কখনো বিমানের প্রশিক্ষণ না হয়।
এদিকে হুমায়রার দাদা আবদুল বাছেদের আর্তনাদে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। তিনি শুধু বলছেন, ‘এবার কুরবানির ঈদে দাদু এসেছিল। দাদু সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই থাকতো। দাদু আর কোনোদিন আসবে না! আর আমাকে দাদু ডাকবে না’!
আপনার মতামত লিখুন :