বাংলা চলচ্চিত্রে ক্ষণজন্মা নক্ষত্র, লেখক, সাংবাদিক জহির রায়হানের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে অভিনেত্রী সুমিতা দেবী এবং ১৯৬৬ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই স্ত্রীই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়।
চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬১ সালে জহির রায়হান ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন।
জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’তে।
তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতায় চলে যান এই পরিচালক। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ‘স্টপ জোনোসাইড’ নামে মুক্তযুদ্ধ ও দেশের মানুষের করুণ চিত্র তুলে ধরে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন।
সে সময়ে চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। মীরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা এবং এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।
তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ১৯৬৪। (হাজার বছর ধরে) নিগার পুরস্কার (‘কাচের দেয়াল’) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবির পুরস্কার। বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৭১। (উপন্যাসঃ মরণোত্তর) একুশে পদক ১৯৭৭। (চলচ্চিত্রঃ মরণোত্তর) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার-১৯৯২ (সাহিত্যঃ মরণোত্তর) সহ নানান পুরস্কারে ভুষিত হন।
শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গু, বরফ গলা নদী, আর কত দিন, কয়েকটি মৃত্যু, একুশে ফেব্রুয়ারী, তৃষ্ণাসহ অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন।
এছাড়া তিনি, কখনো আসেনি, সোনার কাজল, কাচের দেয়াল, সংগম, জুলেখা, সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, সংসার, মনের মত বউ, একুশে ফেব্রুয়ারী, জীবন থেকে নেয়া, লেট দেয়ার বি লাইট, স্টপ জেনোসাইড, বার্থ অব আ নেশন, চিলড্রেন অব বাংলাদেশ, সারেন্ডার, প্রতিশোধ’সহ বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়সব চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
আপনার মতামত লিখুন :