লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম হত্যা মামলার এক বছরেও তদন্তের অগ্রগতি নেই। ধরা পড়েনি জোড়া খুনের মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেম জিহাদী। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোও উদ্ধার হয়নি। বছর পার হলেও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদীসহ নিহতের স্বজনেরা। চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বলে দাবি করেছেন মামলার বাদী ও সাক্ষীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোটরসাইকেলে সদর উপজেলার পোদ্দার বাজার থেকে নাগের হাটে যাচ্ছিলেন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। পশ্চিম বাজার এলাকার ব্রিজের পাশে পৌঁছালে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা তাঁদের গতিরোধ করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। এতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুল্লাহ আল নোমান ঘটনাস্থলে মারা যান। এ ছাড়া হাসপাতালে মারা যান রাকিব ইমাম। পরের দিন ২৬ এপ্রিল নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বাদী হয়ে চন্দ্রগঞ্জ থানায় আবুল কাশেম জিহাদীকে প্রধান করে ১৮ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর এই মামলায় রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক দেওয়ান ফয়সাল, বশিকপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম-আহবায়ক মশিউর রহমান নিশান, আওয়ামী লীগ কর্মী রুবেল দেওয়ান, শুটার রাকিবসহ গ্রেপ্তার করা হয় ২৩ আসামিকে। ধরাপড়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে জামিনে বের হন আসামিরা। তবে গ্রেপ্তার কয়েক আসামি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকার করে জবানবন্দি দেন ।এই হত্যাকাণ্ডের পর জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। তখন চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম জিহাদীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে জামায়াত ইসলামী থেকে আওয়ামী রাজনীতিতে আসেন এই কাশেম, ছিলেন বশিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও। অভিযোগ ওঠে আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দল ও ইউনিয়ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, কাশেম জিহাদী ও তাঁর বাহিনী ২৪টি খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে বিএনপি নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলাম মামলার আসামি ছিলেন জিহাদি। নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড সারা দেশে আলোচিত ছিল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ইউপি নির্বাচন ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবদুল্লাহ আল নোমান ও রাকিব ইমামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গত দুই বছরে এই এলাকায় দলীয় কোন্দলের জেরে নিহত হয় আওয়ামী লীগের চার নেতা-কর্মী। গত ১৫ বছরে আরও একটি জোড়া খুনসহ ১২ নেতা-কর্মী নিহত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ হয়েছে দলীয় কোন্দল, ভাগ-বাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে।
নিহত ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামের ভাই সাইফুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার এক বছর পার হয়েছে। এখনও প্রধান আসামিকে ধরতে পারেনি পুলিশ। চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। আবুল কাশেম জিহাদী বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট সাধারণ মানুষ। জিহাদী ও তাঁর বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করছে না স্থানীয়রা।
রাকিবের মা বলেন, এখনও খুব ভয়ে আছি। কখন আবার কোন মায়ের বুক খালি হয়, সে আশঙ্কায় থাকতে হচ্ছে। আমার একটা ছেলেকে হারিয়েছি, আরেকটা ছেলেকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি দিচ্ছে। আমি এই ছেলেকে হারাতে চাইনা। দ্রুত এই সন্ত্রাসীকে যেন গ্রেপ্তার করা হয় সেটাই এখন আশা।
নিহত আবদুল্লাহ আল নোমানের ভাই ও মামলার বাদী বশিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘটনার এক বছর পার হয়েছে। এখনও মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। যেসব আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে, সবাই এখন জামিনে বের হয়ে প্রকাশ্যেই চলাফেরা করছে। মামলা তুলে নিতে নানা ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। অথচ এখনও প্রধান আসামি জিহাদীকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না পুলিশ। সে গ্রেপ্তার না হওয়ায় পরিবার নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। শিগগিরই জিহাদীকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান মাহফুজুর রহমান। এ ছাড়া তিনি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে এই মামলার আসামিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নুরুল হুদা বলেন, হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এটা সবার প্রত্যাশা। তবে এই আলোচিত মামলাকে কেউ হাতিয়ার বানিয়ে সাধারণ মানুষকে যেন হয়রানি না করে সেদিকে প্রশাসনকে নজর দিতে হবে। সঠিক তদন্ত করে ঘটনার সাথে যারাই জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার দাবি করেন এই আইনজীবী।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, এটি একটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড। জিহাদী দেশেই রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের দাবী জানাচ্ছি এবং অনেক অস্ত্র রয়েছে সেগুলা উদ্ধার করা প্রয়োজন।
লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) হাসান মোস্তফা স্বপন বলেন, এটি একটি আলোচিত মামলা। আমরা ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা এখন জামিনে আছে। আসামীরা নিহতের পরিবারকে হুমকির তথ্য আমাদের কাছে আসেনি। তদন্ত করতে গিয়ে কোনো নির্দোষ মানুষ যেন অপরাধী না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে তদন্ত কাজ অগ্রসর হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই মামলার কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়েছে। প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :