প্রায় অর্ধশত বছর আগে এক বাঙালি নারী, হতেই পারেন তিনি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত বক্তৃতাদানের আগে তার পটভূমি তৈরি করে দিচ্ছেন কী মহান রাজনৈতিক আদর্শের আত্মজিজ্ঞাসা থেকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেদিনের সেই অলিখিত ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এজন্যই শেখ মুজিবুর রহমান আজো বাঙালির বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ-সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা ওড়াতে সক্ষম হয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরে বিখ্যাত সেই ৭ মার্চ-এর ভাষণের পূর্বপরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে (বঙ্গবন্ধু কন্যার লেখা থেকে জানা) একটি আঁচড়ে উজ্জ্বল করে তুলেছেন বঙ্গবন্ধুর পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। তার তিক্ষ্ণ বুদ্ধিতে মহৎ করেছে বালক কালের প্রবীণতাকে ধৈর্য সহকারে। প্রচণ্ড ধীশক্তি দিয়ে পরিচালনা করেছেন স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ ত্যাগী নারী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জাতির সেবায় মনোনিবেশ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, রাজনীতির নানা দুঃসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন গঠনমূলক পরামর্শ। তার বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী পরামর্শসমূহ জাতির জীবনে সুফল বয়ে এনেছে। যা জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব মন্ত্রী হলে বেগম মুজিব মিন্টো রোডের সরকারি বাড়িতে ওঠেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে ১৪ দিনের নোটিসে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাসা ছাড়তে বাধ্য হন বেগম মুজিব। এ রকম অনেকবার তাঁর বাসা বদল করতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নিজেদের বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ওই বছরের ১ অক্টোবর বেগম মুজিব ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বিভিন্ন অংশে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখায় উঠে এসেছে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন, তাকে প্রেরণা-সাহস-উৎসাহ দিয়েছেন। জাতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন।
১৯৬২ সালের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন অন্দোলন শুরু হয় তার কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু প্রেরিত বার্তা মোতাবেক আন্দোলন পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেগম মুজিব। ১৯৬৬ সালে বাঙালির জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করে জনমত সৃষ্টির জন্য সারাদেশে জনসভা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আটবার গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি জীবনযাপন করছিলেন, তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন, ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ অপরাপর ছাত্রনেতার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ ছিল। ৬ দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে রাস্তায় নেমে লিফলেট বিতরণ করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।আর ৬ দফা আন্দোলনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কারাবন্দিদের মুক্তির জন্য ৭ জুনের হরতাল সফল করা, সেটাও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়। গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর তদানীন্তন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। নেপথ্যে থেকে তিনি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। এই গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে সে সময় সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক জান্তা আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা বঙ্গবন্ধু ভবন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সড়কে বেগম মুজিবের কাছে ছুটে যান প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু বেগম মুজিব এক অনমনীয় দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাকে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানি শাসকের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে বেগম মুজিবের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর সেই বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের জন্য আইয়ুব খান জনরোষ থেকে বাঁচতে, ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার, স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটি স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ- স্বাধীনতার এক অবিনশ্বর কেন্দ্র। এই অগ্নিকুণ্ডের প্রধান শক্তি বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব অভিযুক্তরা একসঙ্গে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।
১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দল দাবি তুলেছিল ভোটের আগে ভাত চাই। কিন্তু বেগম মুজিব আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানিরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। শুরু হয়ে যায় পূর্ববাংলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। বাঙালির স্বাধীনতা ও অধিকারের সংগ্রামে ওপরে বর্ণিত এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে যদি বঙ্গমাতা প্রত্যক্ষ অবদান না রাখতেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ১৮নং সড়কের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। চরম মানসিক পীড়ন ও ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু স্বামীর বন্দিদশা এবং পাকিস্তানের কারাগারে তাকে হত্যার আশঙ্কা সর্বোপরি নিজেদের বন্দিত্ব ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি; মাথানত করেননি। ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তাদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। কিন্তু তারপরও বিজয়ের আনন্দ তিনি অনুভব করতে পারেননি। অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং দেশবাসীকেও ধৈর্যধারণের জন্য পরামর্শ দিতে হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। বাঙালি জাতি ফিরে পায় তাদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভেঙ্গে না পড়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে কাজ করেছেন, গরিব-এতিম-অসহায় মানুষদের সাহায্য করেছেন, বীরাঙ্গনাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার মতো মহৎ দায়িত্ব পালন করেছেন।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ বংশের নাম তখন ওই অঞ্চলে বেশ পরিচিত। স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান তার চাচাতো ভাই ছিলেন। শেখ ফজিলাতুন্নেছার পিতামহ শেখ মোহাম্মদ কাশেম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতামহ শেখ আব্দুল হামিদ ছিলেন চাচাতো ভাই। শেখ ফজিলাতুন্নেছার ডাকনাম ছিল রেনু। তার পিতা শেখ জহুরুল হক ও মাতা হোসনে আরা বেগম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি পিতা-মাতা উভয়কেই হারান। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর থেকে তিনি হবু-শাশুড়ি এবং বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুনের কাছে সন্তানের মতো বড় হতে থাকেন।
এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল জাতির পিতার সহধর্মিণীই নন, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অন্যতম এক স্মরণীয় অনুপ্রেরণাদাত্রী। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলার জনগণ তাকে ‘বঙ্গমাতা’ উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতা যেমন আলোকবর্তিতা, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা ও দেশের মানুষের জন্য তার অবদান অনন্য অবিস্মরনীয়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আজকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছেন। আমাদের স্বাধীনতার পতাকাকে বহন করে তিনি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করেছেন। বঙ্গমাতার ৯৩ তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
সাইদ আহমেদ বাবু
সদস্য: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপ কমিটি
সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র মাসিক উত্তরণ
সভাপতি: আমরা ক’জন মুজিব সেনা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।
আপনার মতামত লিখুন :