Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

মানুষের কল্যাণ অগ্রগতিতে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তির ভূমিকা


দৈনিক পরিবার | শাহজাহান আবদালী অক্টোবর ১৮, ২০২৩, ১২:৩১ পিএম মানুষের কল্যাণ অগ্রগতিতে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তির ভূমিকা

আমাদের দেশটির সরকারি নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এটির রাজধানী ঢাকা। আয়তন ৫৬ হাজার ৯৭৭ বর্গমাইল। মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। জাতিগোষ্ঠী ৯৮% বাঙালি, অন্যান্য ২%। ৯০.৪% ইসলাম, ৮.৫% হিন্দু, বাকি অন্যান্য। শিক্ষার হার ৭৩. ৯০%। বিভাগ ৭টি, জেলা ৬৪টি, ৬৫২টি থানা এবং ৮৭,১৯১টি গ্রাম।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ নরনারীর জীবনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক দেশটি। তারপর ১৯৭২ সালে এদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, সপরিবারে তাকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন ৮৩ দিন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তারপর এসেছে জিয়াউর রহমানের বিএনপি সরকার, বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকার, হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের সরকার, বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্বাবধায়ক সরকার,খালেদা জিয়ার বিএনপির সরকার। ফখরুদ্দিনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বর্তমানে একটানা ১৫ বছর ধরে চলেছে শেখ হাসিনার সরকার। উল্লিখিত সব দলের সরকার প্রধান, মন্ত্রী-এমপিসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের মুখে একই কথা- দেশকে আমরা অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছি এবং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উপহার দিয়েছি। এ কথাগুলো বাস্তবক্ষেত্রে কতটুকু সত্যি? এত উন্নয়ন যায় কোথায়? তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এদেশ থেকে উন্নয়ন চুরি কিংবা লুট হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন চুরি কিংবা লুট হয়ে যাচ্ছে, কথাটি তারা বললেও আমরা মেনে নিতে বাধ্য। কারণ এদেশে সবই সম্ভব এবং সবই অসম্ভব। দেশটি অবকাঠামোর দিক থেকে উন্নয়ন  হলেও মানবিকতা ও নৈতিকতার অবনতি হয়েছে।
সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। কেউ কেউ নিজে অন্যায় না করলেও অন্যায়কারীকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া  অনেকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সামর্থ থাকলেও ঝুঁকি-ঝামেলা মনে করে নিশ্চুপ থাকে। সেকারণেই সমাজে খারাপ ও ঘৃণিত মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশটিতে চলছে ধনী-দরিদ্রের সীমাহীন বৈষম্য। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং কর্মহীন শিক্ষানীতির ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে  এদেশটি অসুস্থ দেশে পরিণত হচ্ছে। এই অসুস্থ দেশকে সুস্থ করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সে বিষয়ে কিছু তথ্য আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।  
জাতীয় সংসদ সদস্যদের মূল কাজ হলো, সংসদে আইন প্রণয়ন করা। নিজের নির্বাচনী এলাকাসহ পুরো বাংলাদেশের সংকট ও অসংগতির চিত্র সংসদে তুলে ধরা। দেশের যেসব এলাকা উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে, সেই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সমস্যাগুলো সংসদে উত্থাপনের জন্য সহযোগিতা করা। বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা প্রভৃতি জেলার অনুন্নত এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে উন্নয়নের জন্য ব্যাপক অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব সংসদে তুলে ধরা। কারণ সেসব এলাকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠী দরিদ্র্যের সীমার নিচে বসবাস করছে। ওদের দুর্বিষহ জীবন দেখে মনে হয় না ওরা এদেশের জনগোষ্ঠী। ঢাকা শহরের অধিকাংশ রিক্সাঅলার জন্ম ঐসব এলাকায়। যুগ যুগ ধরে ওরা রাষ্ট্রের নানান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, অর্থাৎ  উন্নয়নের দিক থেকে ওরা পিছিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে, ভবিষ্যতে ঐসব এলাকার কেউ এদেশের সরকার প্রধান হলে ঠিকই উন্নয়ন ধারা সীমা ছাড়িয়ে যাবে।
 এছাড়া জাতীয় সংসদ সদস্যের করণীয় নিজের নির্বাচনী এলাকার অধীনে উপজেলার চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেম্বারের কাছে তাদের ন্যায্য ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্ষমতা প্রদান করা। তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার পথ তৈরি করে দেওয়া। তারা যাতে দুর্নীতি করতে না পারে, সব সময় নজরদারিতে রাখা। দুর্নীতিতে প্রমাণিত হলে সাথে সাথে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
ঢাকা শহরের যানজট অভিশপ্ত জীবনে পরিণত হয়েছে। এ যানজট কমাতে হলে গ্রাম উন্নয়নের দিকে গুরুত্বসহকারে  সরকারের নজর দিতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে উন্নতমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা, সেই সঙ্গে  নটরডেম ও ঢাকা কলেজের মতো উন্নতমানের কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিটি জেলাতে একটি করে উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করার মাধ্যমে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে দিতে পারলে ঢাকা শহর থেকে ছয় মাসের মধ্যে অর্ধেক মানুষ গ্রামে চলে যাবে। অনেক পরিবার ঢাকা শহরে কষ্ট করে দিনাতিপাত করছে শুধু ছেলেমেয়ের উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাসহ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে।
চোখে পড়ার মতো অনেক ঘটনা সমাজে ঘটে যাচ্ছে । এদেশে খারাপ মানুষের মূল্যায়ন দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসী ছেলেরা সমাজে লক্ষ্মীছেলে হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সন্ত্রাসী ছেলেরা ঘর থেকে বের হলে সালাম ও সম্মানের অভাব হয় না। ভয়ে অনেকে ওদেরকে সালাম দেয়। কেউ কেউ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ওদেরকে ব্যবহার করে থাকে। ওদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব। ওরাই অন্যায়কারী, শোষণকারী এবং সমাজপতি। ওরা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। বিশেষ করে সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিজেদের প্রয়োজনে ওদেরকে কাছে টানে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের অধীনে নির্বাচিত পদগুলো থাকে ওদের দখলে। ওদের প্রভাব বিস্তারে দেশের সাধারণ নিরীহ জনগোষ্ঠী অতিষ্ঠ। রাজনীতির পদপদবী পেয়ে অনেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা রকম প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ওদের স্বেচ্ছাচারিতা দেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষকরা চুপচাপ বোবার মতো তাকিয়ে থাকে। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততোদিন রাজা-মহারাজার মতো ওদের জীবন যাপন। বর্তমানে আগের মতো দল পরিবর্তনের তেমন সুযোগ নেই। কারণ দলের মধ্যে প্রতিযোগি ও প্রতিদ্বন্দ্বির সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে বিরোধী দলেই থাকতে হয়। বিরোধী দলে থাকলে একাধিক মামলা ওদের ভাগ্যে ঝুলতে থাকে। তখন ওরা হয়ে যায় পলাতক আসামি। এমন পরিস্থিতিতে ওদের চরিত্রে দেখা দেয় ব্যাপক পরিবর্তন। ওরা নিমিষে হয়ে যায় নম্র-ভদ্র ও বিনয়ী। তখন ওদের মুখ থেকে শুধু নীতিকথা বের হয়। ওদের কথা শুনলে মনে হবে এতো সৎ ও ভালো মানুষ এলাকাতে দ্বিতীয় কেউ নেই।
বর্তমানে যোগ্য লোকের বৈশিষ্ট্য হলো সাহস, নিলর্জ্জ, তোয়াজ ও দালালি। এগুলো যাদের মধ্যে বেশি, তারাই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষায় ওদের কাছে তুচ্ছ। ওরা অনেক কৌশলী বলেই দুর্নীতি ও অবৈধভাবে পয়সা কামিয়ে এলাকাতে অল্পস্বল্প দান-খয়রাত করে সাদা মনের মানুষ ও দানবীর খেতাবে ভূষিত হচ্ছে। কেউ কেউ নিজের পরিবার কিংবা পাড়া প্রতিবেশীর সাথে মারামারি ও দলাদলিতে পরাজিত হয়ে হীরা সমতুল্য সম্তান দিয়ে লোহা সমতুল্য পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করছে শুধু শক্তি সমর্থন পাওয়ার জন্য। সামাজিক বিবেচনায় অনেক নিচে আত্মীয়তার মাধ্যমে শক্তি ও দাপট প্রাপ্তির ফলে যার তার সাথে উঁচু স্বরে বলে, আগের দিন আর নাই।  
দেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ পদ-পদবীর জন্য সত্যকে আড়াল করে লেখালেখির মাধ্যমে কিংবা টিভির টকশোতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের গুণকীর্তন করে থাকেন। অনেকে আবার দালালি ও তোষামোদির বিনিময়ে সরকারি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে লোভনীয় চাকরির সিংহাসনে বসে রাষ্ট্রের দুধের সরগুলো খেতে থাকেন। যোগ্যতা থাক না থাক মেধাবী, সৎ ও যোগ্যদের পেছনে ফেলে তোয়াজ ও দালালির মাধ্যমে কেউ কেউ বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হচ্ছেন। তারা দেশের প্রতিটি সরকারের সরকার দলীয় দালাল বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। এসব দালাল বুদ্ধিজীবী পাকিস্তান শাসনামলেও এদেশে ছিল। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, দলীয় সরকার পতনের পর দুর্নীতি,ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে মন্ত্রী,এমপিসহ নেতাকর্মীরা জেল খাটে, কিন্তু দেশের কবি-সাহিত্যিকসহ বুদ্ধিজীবীদের দালালির দায়ে জেল খাটতে দেখি না কেন? আমার মতে, সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের শাস্তি দ্বিগুন হওয়া উচিত। কারণ, তারা দেশের জ্ঞানী-গুণী এবং জাতির বিবেক। তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডেই সমাজ ও রাষ্ট্র বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও পল্লীকবি জসীম উদদীন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। তাই বলে কী তারা লেখক ছিলেন না?
আমি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে উদ্দ্যেশ্য করে বলছি না, এদেশে নিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বই অনেক পাঠক খুঁজে পাচ্ছে না। এ অভিযোগটি দেশের শতসহস্র পাঠকের। দেশের দালাল লেখক-বুদ্ধিজীবীরা অর্থ ও পদ-পদবীর লোভে যার যার সমর্থিত দলের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীকে খুশি করার জন্য মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে ইতিহাসের বই রচনা করে থাকেন।
বুদ্ধিজীবীদের উচিত দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা, রাষ্ট্রের বাইরে এবং অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র চললে প্রতিহত করা, সরকারের ভুলভ্রান্তি, সঙ্কট ও অসংগতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে তুলে ধরা। সাধারণ জনগণকে সুপথ দেখিয়ে সচেতন করা এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। রাষ্ট্র বেঁচে থাকলে সরকার আসবে আর যাবে। রাষ্ট্রকে সুসংহত রাখার দায়িত্ব তাদেরসহ দেশের সকল নাগরিকের।
দেশে শিক্ষার হার ৭৩% হলেও দুর্নীতি ও নৈতিকতা বিসর্জনের ফলে সমাজে সুশিক্ষিত মানুষ তেমন গড়ে ওঠেনি। এদেশে অনেক সত্য ঘটনা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। ফলে দেখা দিয়েছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। সীমিত পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রীক পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে উচ্চশিক্ষিত হিসেবে দাবি করা যায়। কিন্তু নিজেকে প্রকৃত সুশিক্ষিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও প্রচুর দেশবিদেশের বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞানের বই পড়তে হয়। নামমাত্র উচ্চশিক্ষিত বেকার লোকের দ্বারা সমাজ এবং রাষ্ট্র বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় উচ্চশিক্ষিত বেকার শ্রেণীসহ সাধারণ জনগোষ্ঠী মাত্র পাঁচশত টাকার বিনিময়ে সমাজের কুখ্যাত ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার মিছিলে যোগদান করে ক্যামেরায় বন্দী হতে দেখা যায়। অপরদিকে সুশিক্ষিত, সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে গেলে তার পেছনে লোকজন থাকে না। এসব প্রার্থীর টাকা-পয়সা নেই বলে এলাকার অনেকে তিরস্কার ভঙ্গিতে হাসাহাসি করে থাকে। তাতে করে সৎ ও যোগ্যপ্রার্থী অপমানের গ্লানি নিয়ে পরাজিত হয়। ফলে আমরা যোগ্য ও সৎ জনপ্রতিনিধি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
দেশর শতভাগ মানুষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জ্ঞান-বিজ্ঞানে দেশটি পিছিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছি। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে সবার মুখে শুধু রাজনীতির আলাপ। দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে রাজনীতিবিদ। এত রাজনীতিবিদ বিশ্বের কোনো দেশে আছে কীনা জানা নেই। সমাজের সব কিছুতে রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যায়। ইচ্ছে করলেই নিরপেক্ষ থাকা যায় না। নিরপেক্ষ নিরপেক্ষ সবার বিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত। নিরপেক্ষ মানুষের পেছনে লোকজন তেমন থাকে না। ওরা অসহায় এবং একাকিত্ব জীবন-যাপন করতে থাকে। তবে,অবৈধভাবে পয়সা কামিয়ে এলাকায় গেলে সম্মানের অভাব হয় না। দিনরাত তাদের পেছনে লোকজন ঘুরঘুর করতে থাকে। নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও শেষপর্যন্ত তারা সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষের প্ররোচনা কোনো না কোনো দলে ভিড়তে হয়। রাজনীতির চেয়ে মজার পেশা আর কোনো কিছুতে নেই। সেকারণেই এদেশের রাজনীতি ব্যবসা রমরমা।
কেউ কেউ বিনা লাভেও নিজের সমর্থিত দলের জন্য রক্তক্ষয়ি মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। এসব দলান্ধ লোকের দ্বারা সমাজ তথা পরিবার বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এগুলো দেশের উন্নয়ন নয়, সামাজিক অবক্ষয় এবং কলঙ্কিত অধ্যায়। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় দেশটি থুবড়ে পড়বে।
এদেশে অনেকে বিনা পরিশ্রমে সংসার চালাচ্ছে। তাদের রোজগার নিয়ে প্রশ্ন করলে মারার জন্য তেড়ে আসবে। সমাজে তারা প্রভাবশালী বলেই প্রতিদিন যেখানে সেখানে  গালিগালাজ করে বেড়ায়, এ ভালো না,সে ভালো না। নিজে কতটুকু ভালো এলাকার সবাই জানে।
যাদের পরিশ্রমে দেশটি টিকে আছে তাদের মূল্যায়ন নেই সমাজে। দেশের সিংহভাগ আয়ের উৎস রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস থেকে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা স্বদেশে এলে এয়ারপোর্টের অনেক কর্মকর্তা ট্যাক্স পরীক্ষা-নীরিক্ষার নামে তাদেরকে এক ধরনের নাজেহাল করে ছাড়ে। অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ব্যাগ টানাটানি করে মালামাল গায়েব করে ফেলে। এসব কাণ্ড দেখে ওরা হা করে তাকিয়ে থাকে। এদেশের অধিকাংশ রেমিট্যান্স যোদ্ধা স্বশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত। তাদেরকে বিনা কারণে নাজেহাল করা অমার্জনীয় অপরাধ। এছাড়া তারা প্রবাসে মৃত্যুবরণ করলে তাদের লাশ সরকার জন্মভূমিতে আনার ব্যবস্থা করে না। কিন্ত অন্যান্য দেশের সরকার গুরুত্ব সহকারে প্রবাসী মৃতব্যক্তির লাশ তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়। এটি লাখ লাখ প্রবাসী বাঙালির অভিযোগ।
রেমিট্যান্স যোদ্ধারা জন্মভূমিতে এসে ঘরে-বাইরে কোথাও সম্মান পায় না। কারণ একটাই,ওদের নেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহারি সার্টিফিকেট। অন্যদিকে ঘরে উচ্চশিক্ষিত বেকার ভাইটির ঘরে-বাইরে কত না সম্মান। দশ টাকা রোজগার নেই, অথচ হাতে দামি ঘড়ি,পায়ে দামি জুতা, দামি মোবাইল হাতে এবং চোখে দামি সানগ্লাস। বেকার জীবনে এগুলো কেনার টাকা পায় কোথা থেকে ? এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ, সে রাজনীতি করে। দলের স্থানীয় নেতাসহ চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার গলায় গলায় সম্পর্ক। এই ডিজিটাল যুগে পুঁজি ছাড়া ফিটিং ব্যবসার সঙ্গে সে জড়িত। যাকে তাকে ধরে এনে কোনো ঘটনা সাজিয়ে  অপরাধী বানিয়ে টাকা আদায় করে থাকে। এসব ঘটনা সমাজের নিরীহ জ্ঞানী-গুণীরা স্বচোখে দেখে সুইসাইড করবে কীনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।  
নাপিত,ধোপা, কামার,কুমার, মেথর, কৃষক, জেলে, রিকশাঅলা,তাঁতি, পোশাককর্মী প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রমে দেশ ও জাতি হেসে ওঠে। অথচ তারাই সমাজে বেশি অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত। তারা ভালো খেতে পায় না। তাদের বাসস্থান নিম্নমানের পরিবেশে,পরনে নেই ভালো জামাকাপড়। ওদের মেধাবী সন্তানের নেই উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা। ওদের জন্ম হয়েছে শুধু কষ্টের সঙ্গে সংগ্রাম করার জন্য। জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে দামি জামাকাপড় নেই বলে যে সে ওদের ধমক দিয়ে কথা বলে। সত্যিকার অর্থে ওরাই রাষ্ট্রের খাঁটি মানুষ এবং সমাজ সেবক। সরকারের উচিত  ওদের মেধাবী সন্তানদের বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্রি অর্থাৎ বিনা খরচে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পথ নিশ্চিত করা।
দেশের প্রচলিত আইনগুলো সংশোধন করা অতীব জরুরি। যেমন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ভেজাল খাদ্য কিংবা কোনো একটি ওষুধ ফার্মেসির মালিককে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার অপরাধে দশ/ বিশ হাজার টাকা জরিমানা করতে দেখা যায়। বাস্তবক্ষেত্রে সেই ফার্মেসিতে প্রতিদিনই আয় হচ্ছে নূন্যতম ৫০ হাজার টাকা। শাস্তিমূলক জরিমানার নামে ঐ ফার্মেসির মালিকের শরীরে ব্যথার মালিশ লাগানো হচ্ছে। জরিমানা মাত্রই অসম্মান ও অপমানের। কিন্তু ওদের মানসম্মান নেই বলেই এ ধরনের অপকর্ম করেই চলেছে। এসব অপরাধীর নামমাত্র জরিমানা না করে নূন্যতম এক লাখ টাকা জরিমানাসহ তিন বছরের জেল দিলে পরবর্তীকালে এ ধরনের কাজ করতে চিন্তা ভাবনা করবে। শুধু তাই নয়, এসব ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা হলে অন্যান্য দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতিসহ কারাভোগের কথা বিবেচনা করে অপকর্ম থেকে বিরত থাকবে।
সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে হলে ধনীদের ট্যাক্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। ঢাকা শহরে বাড়ি তৈরি করার আগে রাজুকের অনুমতির জন্য দরখাস্ত করলে রাজুক কর্মকর্তা বাড়ির মালিককে রাস্তার জন্য যে হারে জায়গা ছাড়তে লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়, ঠিক সেই আনুপাতিক হারে যদি এদেশের ধনীদের ওপর ট্যাক্স বসানো হয়,তাহলে অচিরেই ধনীদের ধন-সম্পদের পাহাড় গলতে থাকবে। তাতে করে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য অনেকাংশে কমে আসবে। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে টাকা কামানোর প্রবণতাও কমবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর হলে হিংসা-নিন্দা কমবে এবং দেশের প্রতিটি মানুষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
দেশ থেকে ভিক্ষাপেশা বন্ধ করে দিতে হবে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের এ পেশায় ব্যতিক্রম হিসেবে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। সমাজে কেউ বেকার থাকতে পারবে না। দেশের প্রতিটি সুস্থ মানুষের প্রতিদিন অন্তত ৮ ঘন্টায় কাজ করতে হবে। শিশু ও ছাত্রছাত্রী ব্যতীত কেউ শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার পর প্রতিদিন ৮ ঘন্টায় কাজকর্ম না করে যেখান সেখানে আড্ডা দিলে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। অলস জীবন-যাপন মানে দেশ ও সংসারের বোঝা। দীর্ঘদিন পরিবারে কেউ বেকার থাকলে দেশের পুলিশ বাহিনী কিংবা এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে জবাবদিহি করার জন্য নতুন আইন তৈরি করা অতীব জরুরি। সবাই কাজে ব্যস্ত থাকলে নেশা, ধর্ষণ,পরচর্চা,পরনিন্দা, মারামারি ও খুনোখুনি কমবে এবং দেশের শিক্ষিত বেকার একেবারে হ্রাস পাবে। মেধাবী ছাত্রছাত্রী ব্যতিত সবাই জেএসসি পাসের পর শিক্ষাজীবন সমাপ্তি ঘটিয়ে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। দেশের মানুষকে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের উদ্যোগী হতে হবে। দেশের উৎপন্ন পণ্য নিজের দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভিন্ন দেশে রপ্তানি করতে হবে।  জেএসসি পাসের পর কেউ উচ্চশিক্ষিত হওয়ার প্রত্যাশী হলে লেখাপড়া শেষ করে ভবিষ্যতে সে কোন পেশা নিয়োজিত হবে, সেই সম্পর্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ পরিচালনা পর্ষদের নিকট লিখিত চুক্তিতে আবব্ধ হতে হবে। এমন কী দেশের বাইরে গিয়ে কেউ স্থায়ীভাবে কর্মজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে বিগত দিনে লেখাপড়া করতে গিয়ে রাষ্ট্রের যতো টাকা ব্যয় হয়েছে, সেই পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে ।
 এদেশে বসবাস করছে লাখ লাখ নিরাশ্রয় মানুষ। বিশেষ করে রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমুচ্ছে হাজার হাজার পথশিশু। রাষ্ট্রের খাস জমিতে ওদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়ে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে ওদেরকে পুনর্বাসন করা অপরিহার্য। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে অনেক মানসিক রোগী, অর্থাৎ পাগল নারীপুরুষ চোখে পড়ে। ওদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখি উলঙ্গবস্থায়। গোসলবিহীন এলোমেলো চুল এবং শরীরে লেপ্টে থাকা নোংরা ময়লা দেখে ওদেরকে মানুষ হিসেবে ভাবতে মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এমন সঙ্কট দূর করার লক্ষে সরকারি অর্থায়নে দেশে কয়েকটি বড় ধরনের মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'আশ্রয়ন প্রকল্প' নামে প্রায় লক্ষাধিক গৃহহীনদের গৃহনির্মাণ করে দিয়েছেন, সেকারণে তাঁকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এদেশে যখন যে দল সরকার গঠন করবে তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে এই আশ্রয়ন প্রকল্পটি অব্যাহত রাখার জন্য।
দেশ থেকে বন্ধ করতে হবে চাকরির তদবির বাণিজ্য। বিনা ঘুষে চাকরি হয় না, এটি দেশের সকল পেশার মানুষ অবগত।
লেখাপড়া শেষ করে ৫ লাখ, ১০ লাখ ও ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে যখন কেউ চাকরিতে যোগদান করে,তখন সারাক্ষণ সে দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে, কখন ঘুষের টাকাগুলো রোজগার করবে। ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়ার পর অবৈধভাবে রোজগারে রীতিমতো মনোযোগী হয়ে পড়ছে, অথচ মোটেও তার মধ্যে অবৈধ রোজগার সম্পর্কে অনুশোচনা হচ্ছে না। কারণ, আগে পুঁজি তুলতে হবে। পুঁজি তোলার পর ব্যবসার মুনাফা হিসেবে শুরু হবে বাড়িগাড়ি।
পরিশেষে বলতে হচ্ছে, যেখানে ফাউন্ডেশন দুর্বল, সেখানে স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সমাজ কীভাবে আশা করা যায়। সুতরাং চাকরি বাণিজ্য হচ্ছে দেশের দুর্নীতির মূল উৎস।
শাহজাহান আবদালী
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক
বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা।
(অন্যের লেখা বা শিল্পকর্ম হুবহু নকল করে নিজের নামে প্রচার করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।)

 

Side banner