Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫, ১৬ কার্তিক ১৪৩২

কেন সড়ক নিরাপত্তার নকশায় মানুষের কণ্ঠস্বর জরুরি


দৈনিক পরিবার | ড. মোহাম্মদ শাহীন সরকার অক্টোবর ৩১, ২০২৫, ০২:০৪ পিএম কেন সড়ক নিরাপত্তার নকশায় মানুষের কণ্ঠস্বর জরুরি

সড়ক নিরাপত্তা কেবলমাত্র প্রকৌশলগত বিষয় নয়; এটি মূলত মানুষের আচরণ, প্রেক্ষাপট এবং যাঁরা প্রতিদিন আমাদের সড়ক ব্যবহার করেন তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বোঝার ব্যাপার। বাংলাদেশে পথচারীরাই এখনো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারী। প্রতিদিন শিশুরা স্কুলে যায়, মানুষ বাজারে যায়, কেউ অফিস বা কারখানায় পৌঁছাতে ব্যস্ত সড়ক অতিক্রম করে। তাঁদের যাত্রাপথ প্রায়ই স্বল্প দূরত্বের হলেও ঝুঁকি থাকে বিপুল। জেব্রা ক্রসিং ধুলো ও ক্ষয়ে ম্লান হয়ে যায়, সিগন্যাল অকার্যকর থাকে বা উপেক্ষিত হয়, ফুটপাত দখল করে পার্ক করা গাড়ি কিংবা দোকানপাট। ফলে নির্ধারিত পারাপারের স্থানগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং মানুষ বাধ্য হয় বিপজ্জনক উপায়ে রাস্তা পার হতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্ট (BRSP) এর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথচারী ও চালকদের নিরাপত্তা ধারণায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। পথচারী, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা পথের পাশে বাগান/সবুজ বিভাজন এবং বেড়া স্থাপনের মধ্যে বিভক্ত ছিলেন, যেখানে তারা নিরাপত্তা ও আরামের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে যাত্রীরা এবং কর্মরতরা প্রধানত নিরাপত্তার কারণে পথচারী বেড়া পছন্দ করেছেন। তারা পুলিশ বা সিগন্যালের নিয়ন্ত্রণের চেয়ে উঁচু পথচারী ক্রসিং, ভালো আলো এবং স্পষ্ট রাস্তার চিহ্নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, তাঁরা বিশ্বাস করেন নকশাভিত্তিক ব্যবস্থাই নিরাপত্তা বাড়াতে পারে। 
অন্যদিকে, চালকরা বেড়া ও সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যেমন সিগন্যাল বা পুলিশের উপস্থিতিকে বেশি কার্যকর মনে করেছেন। সংক্ষেপে বলা যায়, পথচারীরা নিরাপত্তার জন্য নকশাভিত্তিক সমাধানকে বেশি গুরুত্ব দেন, আর চালকরা নিয়ন্ত্রণভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেন। চালকরা, বিপরীতভাবে, বেড়া এবং সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ যেমন সিগন্যাল বা পুলিশ উপস্থিতিকে পছন্দ করেছেন, যেখানে বড় যানবাহনের চালকরা আইন প্রয়োগের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন, আর ছোট যানবাহনের চালকরা আরাম বা সবুজ এলাকা কম গুরুত্ব দিয়েছেন। সংক্ষেপে, পায়চারীরা নকশাভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পছন্দ করেন, চালকরা নিয়ন্ত্রণভিত্তিক হস্তক্ষেপকে অগ্রাধিকার দেন। উভয়ের লক্ষ্য এক নিরাপদ সড়ক তৈরি করা কিন্তু তাঁদের উপায় ভিন্ন।
এই বিভাজন দেখায় যে সড়ক নকশা ও বাস্তব ব্যবহারের মধ্যে একটি বড় ফাঁক রয়েছে। অনেক সময় পথচারীরা নির্ধারিত পারাপারের জায়গা ব্যবহার করেন না, কারণ সেগুলো অসুবিধাজনক, নিরাপদ নয় বা ভুল জায়গায় তৈরি। অন্যদিকে, চালকেরা প্রায়ই থামতে চান না, যদি পারাপারের জায়গাটি এলোমেলো মনে হয়, পথচারীরা হঠাৎ আচরণ বদলান, বা সিগন্যাল কাজ না করে। অনেক ক্ষেত্রে অবকাঠামোই ঝুঁকি তৈরি করে যেমন ভুল জায়গায় পারাপার, দুর্বল আলো, সরু মিডিয়ান, বা অনিয়মিত আইন প্রয়োগ যা বিভ্রান্তি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।
দশকজুড়ে বাংলাদেশে শীর্ষনির্দেশিত সড়ক নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রযুক্তিগত মানের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল, ব্যবহারকারীদের নিজে মানিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা করা হতো এবং এটি প্রায়ই দৈনন্দিন বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিল। এই ফাঁক পূরণ করতে মানুষ-কেন্দ্রিক একটি কৌশলসহ-নকশা (co-design) প্রয়োজন, যেখানে পথচারী, চালক, প্রকৌশলী এবং কমিউনিটি প্রতিনিধি একত্রিত হয়ে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধান তৈরি করবেন। সমাধানগুলো হতে হবে প্রযুক্তিগতভাবে সঠিক, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, প্রাসঙ্গিক এবং ব্যবহারযোগ্য।
এই অংশগ্রহণমূলক চিন্তাধারা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত সেইফ সিস্টেম (Safe System) পদ্ধতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এই পদ্ধতি মনে করে মানুষ ভুল করতে পারে, তাই পরিবহনব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সেই ভুল প্রাণহানি বা গুরুতর আঘাতে না পৌঁছায়। সেইফ সিস্টেম কেবল অবকাঠামো নয় এটি মানুষের আচরণ, সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়, এবং যৌথ দায়িত্ববোধের ওপরও জোর দেয়। বাংলাদেশে যেখানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (RHD), বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA), পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS) এর মতো একাধিক সংস্থা একই ক্ষেত্রে কাজ করে, সেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের দিকনির্দেশনা দেখায় যে, দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা তখনই অর্জন সম্ভব, যখন নীতিনির্ধারণে শক্ত নেতৃত্বের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে।
আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গি এই চিন্তাকে আরও শক্তিশালী করে, কারণ এটি শুধু মানুষ কী করে তা নয়, কেন করে তা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। লেখকের আগের গবেষণায় দেখা গেছে, চালকেরা শিশু, নারী বা প্রবীণ পথচারী দেখলে সহানুভূতির কারণে থেমে যেতে বেশি আগ্রহী হন, এবং একা পথচারীর তুলনায় দলবদ্ধভাবে পার হওয়া মানুষকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। অন্যদিকে, পথচারীরা অনেক সময় নিরাপত্তার চেয়ে সুবিধাকে প্রাধান্য দেন বিশেষ করে যখন পারাপারের জায়গা দূরে থাকে বা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা কঠিন হয়। এসব আচরণ অবহেলার ফল নয়, বরং প্রয়োজন ও অভ্যাসের ফল।এই আচরণের পেছনের কারণগুলো বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা জানলে এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব যা মানুষের অভ্যাস ও ধারণা বদলে দেয় শুধু রাস্তার গঠন নয়। ব্যবহারকারীদের দোষারোপ করে সমস্যার সমাধান হবে না; বরং সেবার ঘাটতি, নকশার ত্রুটি ও অবকাঠামোর ভুল অবস্থান চিহ্নিত করাই নিরাপদ ও ব্যবহারবান্ধব সড়ক গড়ার প্রথম ধাপ।
এই ধারণাগুলোর ভিত্তিতে লেখক UPLIFT (Upgrade, Provide, Leverage, Improve, Focus, Target) নামে একটি সহজ ও কার্যকর কাঠামো প্রস্তাব করেছেন, যা যৌথভাবে তৈরি এবং আচরণগত দিক বিবেচনায় রেখে সড়ক নিরাপত্তা বাড়ানোর পথ দেখায়। UPLIFT পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পথচারীদের নিরাপদ পারাপার নিশ্চিত করা। Upgrade ধাপে বর্তমান পারাপারের স্থানগুলোকে আরও দৃশ্যমান ও সহজভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার কথা বলা হয়েছে যাতে শিশু, বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষসহ সবাই সহজে ও নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারেন। Provide ধাপে উঁচু পারাপার, ব্যারিয়ার, ও পর্যাপ্ত আলো স্থাপনের মতো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যাতে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিরাপদ পথে পারাপার করে। Leverage ধাপে স্থানীয় মানুষ, স্কুল ও অফিসগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয় যাতে সবাই মিলে নিরাপদ আচরণের অভ্যাস তৈরি করতে পারে। Improve ধাপে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচার ও রাস্তার পরিবেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন দুটোকে একসঙ্গে করা হয়, যাতে মানুষ শিক্ষা ও বাস্তব পরিবেশ দু’দিক থেকেই নিরাপত্তা অনুভব করে। Focus ধাপে চালক ও পথচারীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও আস্থা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে উভয় পক্ষই একে অপরকে সম্মান করে চলে। সবশেষে, Target ধাপে মানুষের আবেগ ও চিন্তা দু’টো দিকই কাজে লাগিয়ে চিহ্ন, বার্তা ও সুশৃঙ্খল নকশার মাধ্যমে নিরাপদ পারাপারের অভ্যাস গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তার যাত্রা শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে না এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও দাবি রাখে। প্রকৃত নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে যখন সড়ক ব্যবহারকারীরা নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, বরং একটি যৌথ ব্যবস্থার অংশীদার হিসেবে দেখবে। আচরণগত বিজ্ঞান, অংশগ্রহণমূলক নকশা এবং প্রতিষ্ঠানগত দায়বদ্ধতার সমন্বয় দ্বারা এটি সম্ভব।
ড. মোহাম্মদ শাহীন সরকার
অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্ট,
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।  ইমেইল:sarkermo@gmail.com

Side banner