আমাদের মানবিক সম্পর্কের মধ্যে একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে ‘ক্ষমা’, আর এই ক্ষমা’র ভূমিকা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ জরুরী। এরকমটা প্রায়শই আমাদের হয় যে, আমাদের কাছের কেউ, আমাদের সহকর্মী, আমাদের আত্মীয় আমাদের মনে কষ্ট দিয়েছে আর আমরা তাদের সেই কর্মকান্ডকে বা তাদেরকে ক্ষমা করতে পারি না, ক্ষমা করতে পারছি না, ক্ষমা করতে ইচ্ছা করছে না। আমি যদি ক্ষমা করে দেই তবে আমি ছোট হয়ে যাবো, আমার গুরুত্ব কমে যাবে, আমি পরাজিত হয়ে যাবো, লোকে কি বলবে ইত্যাদি নানান ভাবনা ডানা মেলে আমাদের মনের মধ্যে। ফলশ্রুতিতে এই ক্ষমা করতে না পারাটা কে বয়ে বেড়াই সারা জীবন। আবার এরকম অনেকেই আছেন যারা বুঝতেই পারছে না কিভাবে তাদের আচরণ অন্যের মনঃকষ্টের কারণ, অথবা স্বীকারই করতে চাইছে না যে সে অন্যকে ঠকিয়েছে, তাদের কি আমরা ক্ষমা করতে পারি? মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্ষমা করতে পারা বা না পারা যদি আমরা যথাযথ ভাবে করে পারি তবে তা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারী, আমরা বেশ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারি।
গবেষকদের ভাষায় ‘ক্ষমা’ একটা নৈতিক গুন যেখানে আপনি সব কিছুর উর্ধে উঠে, কোন কিছু পাবার আশা ছাড়া, কোন ধরণের বিচার ছাড়া ঐ মানুষগুলো যারা আপনার সাথে অন্যায় করেছে, আপনাকে ঠকিয়েছে, আপনার মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে, আপনি তাদের সাথে ভালো আচরণ করছেন, এমন কি তাদের সাথে আপনার ঐ ভালো আচরণের সময় আপনি এটাও বিশ্বাস করেন যে তারা আবারও আপনার মনঃকষ্টের কারণ হতে পারেন। আপনি শুনিয়ে হোক বা না শুনিয়েই হোক বলেছেন “আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম”। এই ক্ষমা করার পর যদি আপনার মনে হয় আগের ঐ ঘটনাটায় আপনার কিছু পাবার ছিল, আপনার সেটা ঠিক হয়নি তবে বুঝতে হবে ঐ ক্ষমাটা আপনি করতে পারেন নি, অর্থাৎ ক্ষমার ক্ষেত্রে প্রতিটা ঘটনা আলাদা আলাদা বিবেচ্য হওয়া জরুরী।
ক্ষমা করাটা সর্বান্তকরণে হওয়া আবশ্যক কারণ অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারের ফলে সৃষ্ট মনঃকষ্ট বহুদিন বয়ে বেড়াতে গেলে তা আমাদের মনে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং এক সময় যেটা ছোট ছিল তা ধীরে ধীরে বিরাট আকার ধারণ করে। ঐ ক্ষমা না করতে পারার পেছনের মনঃকষ্টটা, অন্যায়টা, বঞ্চনাটা একসময় মানুষের মধ্যে রাগ তৈরি করে, আর ঐ রাগের সাথে আমাদের নেতিবাচক আবেগ মিলেমিশে সময়ের সাথে সাথে একসময় সেটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এই উদ্বিগ্নতা বাড়তে থাকলে সেটা আমাদের বিষণ্ণতার দিকেই ঠেলে দেয়।
যদি আমরা কাউকে ক্ষমা করতে চাই তবে প্রথমে যেটা আমাদের ভাবতে হয় সেটা হলো – আমি যদি তাকে ক্ষমা করে দেই তবে সেটা প্রভাব আমার উপর কি এবং কেমন? আমি যদি ক্ষমা করে দেই তবে আমার ভালো লাগবে কি না, ক্ষমা না করতে পেরে আমি ভালো আছি কি না, আমি ভালো বোধ করছি কি না, আমার দৈনন্দিন জীবন ব্যহত হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ধরুন, আমার পরিবারের কেউ আমার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন, আমি কোন ভাবেই সেটাকে মেনে নিতে পারছি না, আমার খুব কষ্ট লেগেছে। আমি আমার পরিবারের সেই সদস্যকে ক্ষমা করতে পারছি না। এই ক্ষেত্রে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে উপরে উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে। আমাকে তখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে আমি আমার সাথে হয়ে যাওয়া বা ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাটার যে নেতিবাচক রেশ তা আমি বয়ে বেড়াবো কি না, নাকি এটাকে এখানেই মিটমাট করে নিবো? তাই আমরা যাদের ক্ষমা করতে চাই বা করি তাদের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করি, আমরা আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অপ্রীতিকর ঘটনাকে নতুন করে ইতিবাচক কিছুর সাথে সংযুক্ত করতে চাই, এভাবেই আমরা ক্ষমা করার জন্য প্রস্তুত হই। এই পুরো বিষয়টাই আমরা যারা ক্ষমা করতে চাই তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যপার এবং তাতে যাকে আমরা ক্ষমা করতে চাই তার কোন ধরণের প্রভাব নাই, তবে তারা যদি তাদের ভুল বা অন্যায় বুঝতে পেরে সরাসরি বা ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে তবে তা ক্ষমাকারীর জন্য বিশেষ সাহায্য হয়।
অনেকেই এই ভেবে ক্ষমার আশ্রয় নেন যেখানে অন্য আর কোন কিছু কাজ করছে না, যেখানে আর কোন কিছু পাওয়ার আশা নেই। হয়তো সে জন্যই বয়স্ক মানুষের মধ্যে ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত তরুণ মানুষের তুলনায় বেশী। তাই “আমি দুঃখিত” এই দুটো শব্দ আর “আমি তোমায় ক্ষমা করে দিলাম” এই পাঁচটা শব্দ মনের ক্ষত সারাতে দারুণ ভাবে কার্যকর, এখন আপনার মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনি কোনটা ব্যবহার করবেন সেটা একান্তই আপনার।
ডক্টর আশীক মোহাম্মদ শিমুল
সাবেক সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া








































আপনার মতামত লিখুন :