Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২

ইস্তাম্বুলে নির্মিত শেষ উসমানীয় মসজিদ


দৈনিক পরিবার | ধর্ম ডেস্ক অক্টোবর ১৭, ২০২৫, ০১:১৭ পিএম ইস্তাম্বুলে নির্মিত শেষ উসমানীয় মসজিদ

১৮৮৬ সালে নির্মিত ইলদিজ জামে মসজিদ ছিল এক অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তি যেখানে মিশে গেছে নব্য-গথিক ও মুরিশ শিল্পরীতি। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ আশা করেছিলেন, এটি হবে সাম্রাজ্যের শক্তি ও আধুনিকতার প্রতীক। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই জৌলুস ম্লান হয়ে পড়ে, আর ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায় ইস্তাম্বুলের এই শেষ সুলতানি মসজিদ।
ইসলামী নগর ইস্তাম্বুল
ইস্তাম্বুল মানেই নানা সংস্কৃতি ও সভ্যতার মেলবন্ধন। কিন্তু একসময় এই শহর ছিল ইসলামী বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র অটোমান খিলাফতের রাজধানী, যেখানে হাজারো মসজিদের মিনার আকাশ ছুঁয়েছিল।
১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ কনস্টান্টিনোপল জয় করার পর থেকেই শুরু হয় শহরের ইসলামায়নের অধ্যায়। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করে তিনি ঘোষণা দেন, এটি হবে মুসলমানদের নতুন কেন্দ্র। পরবর্তী সুলতানরা নিজেদের শাসনের স্বাক্ষর রেখে যান একেকটি স্থাপত্যে সুলেমানিয়া, ফাতিহ, নীল মসজিদ সবই অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক।
উনিশ শতকে এসে সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয়ের শাসনামলে এই ঐতিহ্যে যোগ হয় নতুন ভাবনা। ক্রমাগত ভূখণ্ড হারানো, ইউরোপীয় আধুনিকতার চাপে ক্লিষ্ট সাম্রাজ্য তখন নতুন এক ধারণা খুঁজে বেড়াচ্ছিল যা একদিকে ইসলামের ঐক্য বহন করবে, অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাবে। সেই ভাবনারই স্থাপত্যরূপ হলো ইলদিজ হামিদিয়া জামে মসজিদ।
সুলতানের স্বপ্নের মসজিদ
ইস্তাম্বুলের বেসিকতাস পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত এই মসজিদ নির্মাণে নেতৃত্ব দেন অটোমান দরবারের প্রধান ও বিখ্যাত স্থপতি সারকিস বালিয়ান। তার সঙ্গে ছিলেন আর্মেনীয় স্থপতি দিকরান কালফা।
১৮৮৬ সালে উদ্বোধন করা মসজিদটি। মসজিদটি ছিল শৈল্পিক উদ্ভাবনের এক অনন্য উদাহরণ। বাহিরের দেয়ালে দেখা যায় নব্য-গথিক রীতি, আর ভেতরে মুরিশ বা আন্দালুসীয় অলংকরণ। বিশাল নীল গম্বুজের ভেতর সোনালি তারকায় লেখা আছে সূরা ইখলাসের আয়াত। দেয়ালজুড়ে কুফি লিপিতে সূরা আল-মুলকের আয়াত লিখেছেন বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার আবদুল লতিফ এফেন্দি।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, মসজিদের কাঠের জালি ও মিম্বার সুলতান আবদুল হামিদ নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন দক্ষ কাঠশিল্পী; স্পেনের আলহামরা প্রাসাদের নকশা দেখে তিনি এই নকশা করেছিলেন।
জাঁকজমক আর প্রভাবের প্রতীক
জার্মান সম্রাট কাইজার ভিলহেলম দ্বিতীয় মসজিদে উপহার দিয়েছিলেন এক বিশাল ঝাড়বাতি। এই উপহার তৎকালীন সময়ের জার্মান–অটোমান বন্ধুত্বের প্রতীকী গুরুত্ব প্রমাণ করে।
সুলতান প্রত্যেক শুক্রবার এই মসজিদে জুমার নামাজে অংশ নিতেন। তার আগমনে রাস্তা ভরে যেত উচ্ছ্বসিত জনতায়। জুমার খুতবায় ‘সেলামলিক’ রীতি চালু ছিল। এটি ছিল অটোমান শাসকদের ধর্মীয় বৈধতার এক দৃশ্যমান প্রকাশ যেখানে খুতবায় সুলতানের নাম উচ্চারিত হতো বিশ্বের মুসলমানদের খলিফা হিসেবে। কিন্তু এখানেই ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা। ১৯০৫ সালে এই মসজিদের বাইরে আর্মেনীয় বিপ্লবীরা সুলতানের ওপর বোমা হামলার চেষ্টা চালায়। সৌভাগ্যবশত সেদিন তিনি ইমাম শায়খুল ইসলাম-এর সঙ্গে কিছুটা সময় কথা বলেন, ফলে বিস্ফোরণের সময় তার গাড়িটি দেরিতে বের হয় এবং তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু ২৬ জন নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে।
অটোমান পতন ও বিস্মৃতির ছায়া
সুলতান আবদুল হামিদের পতনের পরও মসজিদটি অটোমান ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানেই নামাজ পড়তেন পরবর্তী সুলতানরা। কিন্তু ১৯২৪ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠনের পর রাজধানী চলে যায় আঙ্কারায়, আর ইস্তাম্বুল হারায় তার রাজনৈতিক মর্যাদা।
নতুন প্রজাতন্ত্র আধুনিকায়নের নামে ইসলামী ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যায়। আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়, এমনকি নীল মসজিদকেও আর্ট গ্যালারিতে রূপ দেওয়ার আলোচনা চলে। ইলদিজ জামে মসজিদও পড়ে থাকে অবহেলায়, চারপাশের এলাকা পুনর্র্নিমাণে তার শৌর্য হারিয়ে যায়।
ফরাসি স্থপতি অঁরি প্রোস্ট ১৯২০–৩০ দশকে ইস্তাম্বুলের নগর বিন্যাস নতুন করে সাজান। এর ফলে অনেক অটোমান স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়, আর ইলদিজ মসজিদ একাকী দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়চূড়ায় নীরব এক স্মারক হিসেবে।
আধুনিক তুরস্কে ইলদিজ জামে মসজিদের সংস্কার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রী আদনান মেনদের ইসলামী ঐতিহ্যে নতুন করে আগ্রহ দেখান। আরবি ভাষায় আজান দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, অনেক পুরোনো মসজিদ সংস্কার করেন। তবে ইলদিজ তখনও সময়ের ধুলোয় ঢাকা থাকে। শেষ পর্যন্ত একবিংশ শতাব্দীতে এসে, একে পার্টি সরকারের আমলে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ পুনরায় সংস্কার করা হয়। চার বছরের সংস্কার শেষে ২০১৭ সালে এটি আবার খুলে দেওয়া হয় জনসাধারণের জন্য।
বর্তমানে ইস্তাম্বুলে অসংখ্য নতুন মসজিদ নির্মিত হলেও, ইলদিজ জামে মসজিদের মতো স্থাপত্য আর তৈরি হয়নি। এটি শুধু একটি মসজিদ নয়, এটি একটি সাম্রাজ্যের স্বপ্ন, সংগ্রাম ও স্মৃতির প্রতীক।
রাষ্ট্র যখন ঠিক করে দেয় কী স্মরণ করা হবে আর কী ভুলে যাওয়া হবে, তখন ইতিহাসের স্মারকগুলো নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। ইলদিজ জামে মসজিদ আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই বিস্মৃত গৌরবের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ইস্তাম্বুলের আকাশে অটোমান ঐতিহ্যের শেষ মিনার হিসেবে।
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর

Side banner