আমি চলে যাবো, রেখে যাবো উড়ে যাওয়া পাখি, মেঘের গর্জন, বর্ষার কদমফুল, হিজলের গোলাপি ফুলে দখিনা হাওয়ায় মাখানো বুনো গন্ধ, নীল আকাশে তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো আলোথালো মেঘের খন্ড, জাম গাছের ডগায় বসে কোকিলের কুহু কুহু ডাক আরও কতো কি!
একটা বেশ জনপ্রিয় গানের প্রথম দুই লাইন বেশ মনে পড়ছে -
“এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে,
সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন
চলে যেতে হবে রে মন, চলে যেতে হবে।”
এই গানের রচয়িতা, বিজয় সরকার যেই ক্ষণে এই গানের কথাগুলো লিখেছিলেন তখন বোধ করি উনার ভীষণ রকমে মৃত্যু চিন্তা হয়েছিল আর সেই চিন্তাকে, অনুভূতি আর মূল্যায়নকে শব্দের জালে এবং সেই সাথে সুরের শিকলে বন্দি করেছিলেন দারুণ মোহ মায়ায়। আমাদের মধ্যেও দিবারাত্রি এই চিন্তা উকিঝুঁকি মারে আর এই গানের কথাগুলো (চাইলে এই লিঙ্কে গিয়ে পুরো গানটার কথাগুলো পড়তে পারেন- যঃঃঢ়ং://ষুৎরপং৭১.হবঃ/ষুৎরপং/বর-ঢ়ৎরঃযরনর-লবসড়হ-ধপযব/) যেন আমাদের ঐ চিন্তাকে দারুণভাবে প্রতিফলিত করেছে, তাইতো এই গান আমাদের কাছে এতো জনপ্রিয়।
জীবনের যে উপসংহারকে আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবো না সেটা হলো মৃত্যু। যবে আমাদের মৃত্যু চিন্তা হয় তখন আমরা আমাদের যাপিত জীবনের পুরো সিনেমাটার একটা মূল্যায়নের সামনে নিজেদের দাঁড় করাই, হিসেব করে দেখি আমাদের কর্ম, আমাদের সম্পর্ক, আমাদের চিন্তা চেতনা, সাফল্য আর ব্যর্থতা। কারও কারও সিনেমা সময়ের ব্যপ্তিতে বেশ বড়, তবে ঘটনার ঘনঘটায় কেউ কারও থেকে কম নয়। প্রতিটা জীবন চরম নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ।
মানুষ মৃত্যুর ধারণাটি নিয়ে প্রথম চিন্তা করা শুরু করে যখন সে তার নিজের সামনে অন্য একজনের মৃত্যু দেখে। আমারটা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে যখন আমার সামনে আমার দাদী মারা যান। যাই হোক, এই মৃত্যু চিন্তা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে মানুষ গভীর দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান করেছে, যা আমাদের চেতনা, আবেগ এবং আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের জটিল দিকটাকে উন্মোচিত করেছে। এই অন্বেষণের একটি আকর্ষণীয় দিক হল মৃত্যুর চিন্তা ভাবনা এবং ক্ষমা করার ক্ষমতার মধ্যে সম্ভাব্য যোগসূত্র। আমাদের যাপিত জীবনের বহু মুহুর্তে আমরা নিজেরা অন্যের কষ্টের কারণ হয়েছি আবার অন্যেরাও আমাদের নিজেদেরকে নিদারুণ কষ্টে নিপাতিত করেছে। "আমি চলে যাবো" এই ভাবনা আমাদেরকে পেছনে ফিরে ঐ সব মুহুর্তের কষ্টগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করছি তার উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক মনোবৈজ্ঞানিক আর মনোসামাজিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে কীভাবে একজনের নিজের মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা ঐ ব্যক্তির নেতিবাচক অনুভূতি এবং বিরক্তি প্রকাশ করার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারে, আর ফলশ্রুতিতে মানুষকে ক্ষমা করার সেই সাথে ক্ষমা চাওয়ার প্রতি দারুণ মনোভাব গড়ে তোলে।
আমি আপনাদেরকে একটা গবেষণার কথা বলি। জোনাস এবং তার সহকর্মিরা মিলে ২০০৬ সালে একটা গবেষণা করেন যেখানে তারা দেখিয়েছেন যে কিভাবে আমাদের মৃত্যু চিন্তা আমাদের আশেপাশের মানুষদের ক্ষমা করার উপর প্রভাব বিস্তার করে। জোনাস এই গবেষণায় যারা অংশ নিয়েছিলেন তিনি তাদেরকে দুটি গ্রুপে ভাগ করেছিলেন। একটি দলকে তিনি বলেছেন, আপনারা আপনাদের নিজের মৃত্যুর বিষয়ে গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করবেন (ধরুন- সাদা দল), আর অন্য দলকে (ধরুন- লাল দল) মৃত্যুর সাথে সম্পর্কহীন একটি নিরপেক্ষ বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করতে বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে, উভয় দলের সামনে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে কিছু মানুষ তাদেরকে অসন্তুষ্ট করেছিল, তাদের মনে কষ্ট দিয়েছিলো। গবেষকরা দেখেছেন যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা তাদের নিজেদের মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করেছিল (সাদা দল) তারা লাল দলের মানুষদের তুলনায় (যাদের মৃত্যুর কথা মনে করানো হয় নি) যারা তাদের অসন্তুষ্ট করেছিল তাদের প্রতি বেশী ক্ষমা প্রদর্শন করেছিল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে মৃত্যু ভাবনা আমাদেরকে নেতিবাচক অনুভূতি এবং মনঃকষ্টগুলিকে ছেড়ে ক্ষমা করার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে। জোনাসের এই গবেষণা আমাদের এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, মৃত্যু চিন্তা আমাদের ফেলে আসা মানবিক সম্পর্কগুলোর দ্বন্দ্ব নিরসন এবং সম্পর্ক মেরামত করার ইচ্ছা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
আপনাদের মনে নিশ্চয়ই এখন একটা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে- সারাজীবন মানুষটা ক্ষমা করলো না অথচ নিজের মরণের কথা মনে করার কারণেই সে ক্ষমা করে দিলো? আমি বলছি- হ্যাঁ, নিজের মরণের কথা স্মরণ করার কারণেই সে ঐ ক্ষমাটা করতে পেরেছে। গবেষণা বলছে, মানুষ যখন তার নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবে তখন তার মনে ভয়বহ রকমের দুশ্চিন্তা ভর করে। তবে, অঙ এবং তার সহকর্মীরা ১৯৯৪ সালে তাদের এক গবেষণায় পেয়েছেন যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে মৃত্যু নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশী, আর ছেলেরা মৃত্যুকে যতটা একসেপ্ট করে নিতে পারে মেয়েরা ততটা পারে না। যাই হোক, এই দুশ্চিন্তার হাজারো রকমের কারণ থাকতে পারে কিন্তু মৃত্যু ভাবনায় মানুষের যে তিনটা দুশ্চিন্তা হয় তা হলোঃ ১) আমার চলে যাওয়াটা কেমন করে হবে? ২) আমি চলে গেলে অন্যদের কি হবে? আর ৩) যেখানে যাচ্ছি সেখানটা কেমন? এই অজানাকে মানুষের মন জানতে চায় আর সেজন্যেই দুশ্চিন্তা হয়, আর অন্যকে ক্ষমা করার এবং ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে সে তার ঐ দুশ্চিন্তাকে, ঐ মৃত্যু আতঙ্ককে মোকাবেলা করতে চায়।
মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমুন্নত এবং সুসংহত হয় যদি মানবিক সম্পর্কের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ আর কলহ কম থাকে। মৃত্যুর ভাবনা কলহ আর বিদ্বেষের পেছনে দায়ী মানুষগুলোকে ইতিবাচক ভাবে দেখতে সাহায্য করে ফলশ্রুতিতে তাদের জন্য ক্ষমা করাটা সহজ হয় আর সেই সাথে ক্ষমা চাওয়াটাও। মানুষের মধ্যে মহানুভবতার যে গুণ সেটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে যদি মানুষ তার চিরতরে চলে যাওয়ার ভাবনায় মশগুল থাকে আর এই বিষয়টা সকল কৃষ্টির মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আপনারা জানলে অবাক হবেন যে, আমাদের মৃত্যু চিন্তা থেকে উদ্ভূত দুশ্চিন্তা খুব দ্রুত হ্রাস পায় যদি আমাদের জীবনে আমরা যেসব মানবিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলাম (যেমন বাবা-মায়ের সাথে, ভাই-বোনের সাথে, সন্তানদের সাথে, ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে, ইত্যাদি) সেগুলো যদি যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ বা লালন করতে পারি। আর মানবিক সম্পর্কগুলো তখনই বেশ মজবুত হয় যখন সেখানে ক্ষমার (ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করা) প্রাধান্য থাকে। আমাদের সচরাচর জীবনেও দেখতে পাই যে, মানুষ তাদের জীবন সায়াহ্নে তাদের কাছে মানুষদের সান্নিধ্য চায়, মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি ভুলে একাকার হয়ে যেতে চায় সম্পর্কের মায়জালে।
তাই এই ব্যস্ত জীবনে ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যতটা জরুরী ঠিক ততটাই জরুরী মানবিক সুম্পর্ক গুলোকে লালন করা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে যখনি কোন মানসিক পীড়ন অনুভব করি আমি আমার চিরতরে চলে যাওয়া তথা মৃত্যু নিয়ে বেশ চিন্তিত হই, ফলশ্রুতিতে আমার কারও কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং কাউকে ক্ষমা করাটা সহজ হয়, আর মানসিক ভাবে একটা প্রশান্তি অনুভব করি। আমার বোধে উদয় হয় যে, এই হানাহানি, এই অহংকারের দম্ভ, এগুলোর কিছুই আমার সাথে ওপারে যাবে না, আমার মৃত্যুর সাথে সাথেই এসবের সমাপ্তি, তাই দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে মানসিক নির্যাতন সহ্য করাটা নেহায়েতই বোকামি, সুন্দর সময়কে উপভোগ করা আর এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
ডক্টর আশীক মোহাম্মদ শিমুল
রবার্ট স্ট্রিট
নিউক্যাসেল, অস্ট্রেলিয়া
৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং
আপনার মতামত লিখুন :