ভারতের জম্মু, পাঞ্জাব ও রাজস্থানে পাকিস্তান একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত। জবাবে পাকিস্তানের লাহোরে হামলা চালানোর দাবি জানিয়েছে নয়াদিল্লি। তবে ভারতে মিসাইল ও ড্রোন হামলার খবরকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। এমনকি গতকাল রাতে লাহোরে নতুন করে কোনো হামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ।
ভারতের সামরিক সূত্রের বরাতে আল জাজিরার লাইভ প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের তিনটি সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। ভারতীয় সামরিক সূত্র জানায় জম্মু ও কাশ্মীর, রাজস্থানের জয়সালমির ও পাঞ্জাবের পাঠানকোটে হামলা চালায় পাকিস্তান। ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সবগুলো হামলা মাঝ আকাশেই ভূপাতিত করেছে। একই সঙ্গে ভারত তিনটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি জানিয়েছে। এক পাকিস্তানি পাইলটকে আটকের খবরও এসেছে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পিটিভির খবরে বলা হয়েছে, ভারতের হামলার যে খবর গণমাধ্যমে এসেছে তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। একই সঙ্গে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবরকেও মিথ্যা বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ। দেশটির তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে এফ-১৬ এবং জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার যে দাবি করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ হাস্যকর ও মিথ্যা। এ ধরনের বানোয়াট গল্প বাস্তবে কোনো ফল বয়ে আনবে না। এসব ভিত্তিহীন দাবি শুধু ভারতের হতাশাই প্রকাশ করে। আমরা এ দাবি জোরালোভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছি।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ভারতে হামলার খবর অস্বীকার করে বিবিসিকে বলেছেন, ‘যেদিন পাকিস্তান আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেবে, সেদিন তা পুরো বিশ্ব জানবে। আমরা আমাদের কোনো পদক্ষেপ অস্বীকার করব না।’ লাহোরে নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে পাকিস্তান পুলিশের ডিআইজি ফয়সাল কামরান। সিনিয়র এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, লাহোর কিংবা শিয়ালকোটে কোনো ধরনের ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেনি।
তবে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জম্মুতে বৃহস্পতিবার একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কাশ্মীরজুড়ে ব্ল্যাকআউট এবং সাইরেনের শব্দ শোনার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পাকিস্তানের ড্রোন হামলায় এসব বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ভারতের সেনা কর্মকর্তারা। বিবিসি বলেছে, কাশ্মীরজুড়ে ব্ল্যাকআউট চলছে, লোকজনকে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে।
পারমাণবিক শক্তিধর এ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে গতকাল দ্বিতীয় দিন ধরে চলা সংঘাতের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি শান্তির আহ্বান জানালেও পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। দুটো দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে গতকাল দিনভর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বলেছেন, ‘প্রতিশোধ নেয়া এখন প্রায় নিশ্চিত।’ অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘কোনো হামলা চালালে কঠোর জবাব দেবে ভারত।’
ইসলামাবাদের দাবি, পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে ভারত। ভারতের ২৫টি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করার দাবিও করেছে ইসলামাবাদ। অন্যদিকে ভারত বলেছে যে পাকিস্তান তাদের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। নয়াদিল্লির দাবি, ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাকিস্তানের ড্রোন ও মিসাইল হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ রয়টার্সকে বলেছেন, ‘প্রতিশোধ নেয়া এখন প্রায় নিশ্চিত। আমি এখনো ১০০% বলছি না, কিন্তু পরিস্থিতি খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। আমাদের জবাব দিতেই হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেছেন, ‘ভারত থেকে পাঠানো ২৫টি ইসরায়েলি ড্রোন করাচি ও লাহোরসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এছাড়া রাওয়ালপিন্ডির ওপর দিয়ে একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের কাছে। এছাড়া লাহোরের কাছে একটি ড্রোন হামলায় চার সেনা সদস্য আহত হয়েছেন।’
পাকিস্তানের ‘একাধিক স্থানে’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও রাডার নিশানা করে আঘাত হানার দাবি করেছে ভারত। দেশটির দাবি, তাদের হামলার ফলে লাহোরে একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘অকার্যকর’ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ভারত সরকার এ দাবি করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান ৭ ও ৮ মে রাতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেকগুলো সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করতে চায়। এসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের সবক’টিই ইন্টিগ্রেটেড কাউন্টার ইউএএস গ্রিড এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, কাশ্মীরের অবন্তিপুরা, শ্রীনগর, জম্মু, পাঠানকোট, অমৃতসর, কাপুরথালা, জলান্ধর, লুধিয়ানা, আদমপুর, ভাতিন্ডা, চণ্ডীগড়, নাল, ফালোদি, উত্তরলাই, ভুজসহ ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর অনেকগুলো স্থাপনা লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল পাকিস্তান। সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখন সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, এর জবাবে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় এয়ার ডিফেন্স রাডার ও সিস্টেমগুলোকে নিশানা করেছে।
ভারতের বক্তব্য অনুযায়ী, পাকিস্তান কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি রেখা বরাবর গোলাবর্ষণের তীব্রতা বাড়িয়েছে, যার ফলে ভারতীয় অংশে ১৬ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচ শিশু ও তিন নারী রয়েছে। পাকিস্তান বলেছে যে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও পরবর্তী কাশ্মীর সীমান্তে গোলাবর্ষণে তাদের ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৫০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গতকাল এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাতের বেলা জম্মু ও কাশ্মীরের কুপওয়ারা, বারামুলা, উরি ও আখনূর এলাকার উল্টোদিকে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তানি সেনাচৌকি থেকে বিনা উসকানিতে ছোট অস্ত্র থেকে গুলি এবং কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়।’ ভারতীয় সেনারা সে অনুযায়ী জবাব দিয়েছে বলেও ওই বিবৃতিতে বলা হয়। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নিশ্চিত কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। প্রচণ্ড গোলাগুলির কারণে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে বহু মানুষ।
এদিকে গতকাল দুপুরে নয়াদিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ সামরিক অভিযানে শতাধিক জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে বৈঠকে দাবি করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি বলেন, অভিযান এখনো শেষ হয়নি। তবে ভারত আর কোনো হামলা চালাতে চায় না। কিন্তু পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালালে তার উপযুক্ত জবাব দিতে ভারত প্রস্তুত। বৈঠকে প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা এ সময়ে সরকারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার সংসদে বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে ৪০-৫০ ভারতীয় সেনাকে হত্যা করেছে ও ভারতীয় সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে।’ অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠুক, তা আমরা চাই না। তবে আমাদের ওপর আঘাত এলে নিঃসন্দেহে আমরা তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করব।’
এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের কার্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। সামরিক অপারেশন প্রধানদের হটলাইনও চালু রয়েছে। যদিও তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
আপনার মতামত লিখুন :