Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশনামা


দৈনিক পরিবার | দিদারুল ফেরদৌস নভেম্বর ৫, ২০২৩, ১০:০৩ পিএম পুলিশনামা

পুলিশে যোগ দেবার আগে আমি নিজেও অসংখ্য রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। পড়াশোনা যতটুকু করা দরকার সেটাও ঠিকঠাকই করেছি। কিন্তু চাকুরিতে যোগ দেবার পর পর একটা একটা লালিত স্বপ্ন বিষ মাখানো হতে লাললো যেন।
একটা বছর সারদায় প্রশিক্ষণ কালের কথাই যদি বলি, দিনভর গাধার খাটুনির সাথে দৈনিক ২৩ টাকা সরকারী বাজেটের খাবার তিন বেলার জন্য বরাদ্দকৃত। ভাবা যায়? জেলখানাতে কয়েদীদের জন্য দৈনিক বাজেট কি ২৩ টাকাই? আপনারাই ভালো জানবেন। কিন্তু সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের বেসিক ট্রেনিং এ থাকা টগবগে যুবকদের সকালে আর বিকেলে দুই পিস শক্ত হয়ে থাকা লাল রুটি সাথে সেই রুটিতে মোড়ানো এক টেবিল চামচ শুকনো সবজি, দুপুরে ভাত ডাল আর এক পিস মাছ দিয়ে তাদের শরীর চলে? ফলে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে উপযুক্ত খাবারে ব্যবস্থা করতে হতো। প্রশিক্ষণ কালে যত পোশাক, ইউনিফর্ম, বুট, বেল্ট, স্যুট টাই সব কিছুই নিজেদের কেনা। সরকারী কোন বরাদ্দ নেই! গোটা এক বছর সামর্থ্য ভেদে লক্ষাধিক টাকা এক এক জনের ব্যয়। প্রশিক্ষণ শেষে যেদিন প্রথম থানায় যোগ দেই, ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে। এক খানা খালি টেবিলের সাথে থাকা বসার চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখি আরেকজন অফিসার এসে আমার পাশে উসখুশ করছেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে বলেই বসলেন, ভাই আমার জরুরী কিছু কাজ আছে...। দূরের আরেকটা খালি চেয়ার দেখিয়ে বলেন, কিছু যদি মনে না করেন ওখানে বসবেন, প্লিজ।  
আমি অপ্রস্তুত হয়ে কি করবো খানিক ভাবছিলাম। ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলাম। কিন্তু উঠে গিয়ে খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। কিন্তু আরও কিছুক্ষণ পরে আরেকজন অফিসার এসে আমাকে একইভাবে উঠিয়ে দিলেন। অপমানে লজ্জায় সে রুম ছেড়ে দিয়ে ডিঊটি অফিসারের কক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা চেয়ারে বসলাম। ডিঊটি অফিসার র‌্যাংকে জুনিয়র, তিনি বোধ হয় আমার লজ্জায় রক্তিম হয়ে থাকা মুখ দেখে কিছু আঁচ করেছিলেন। আমাকে আশ্বস্ত করে তিনি জানালেন, স্যার থানায় যত টেবিল, চেয়ার, ফাইল কেবিনেট দেখছেন সবই সংশ্লিষ্ট অফিসারদের পকেটের টাকায় কেনা, একটাও সরকারী নয়। তাই যার যার কেনা টেবিল চেয়ারে সে সে বসে। বদলী হয়ে অন্য কোন স্টেশনে গেলে সাথে নিজের কেনা টেবিল চেয়ার, কেবিনেট সহ নিয়ে যায়!
এবার আসি প্রথম মোবাইল ডিঊটিতে যাবার কথায়। আমাকে একটা পাবলিক লেগুনা দেয়া হল। সাথে চার জন পুলিশ। রাত আটটা থেকে পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত একটা এলাকায় টহল দিতে হবে। পুলিশ চার জন পেছনে গিয়ে বসলো, আমি ড্রাইভারে পাশে। গাড়ি ষ্টার্ট দেবার আগেই ড্রাইভার জানিয়ে দিলো, স্যার তেল লাগবে। আমি জানতে চাইলাম, তেল আগে থেকে নিয়ে আসে নাই কেন? গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। পরে সাথের পুলিশ সদস্যরা জানালো, যে অফিসার ডিঊটি করেন, তেল তাকেই কিনে দিতে হয় নিজ পকেটের টাকায়। শুধু তাই নয়, ড্রাইভার আর হেলপারকেও একবেলা খাবারের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট অফিসারকেই করতে হয়। লেগুনা সমিতি শুধু গাড়ির ব্যাবস্থা করে দেয় সকাল বিকাল, তেল আর শ্রমিকের খাবার তারা দেন না। এখানেই শেষ নয়, থানায় প্রয়োজনীয় কাগজ, কলম, স্টেশনারী, বর্তমানে কম্পিউটার, প্রিন্টার, প্রিন্টারের টোনার, এমনই অসংখ্য মালপত্র, কোন কিছুই সরকারী টাকায় কেনা নয়। হয় থানার ওসি ব্যবস্থা করেন, নইলে সংশ্লিষ্ট অফিসার নিজের টাকায় কেনেন। ভাবতে পারেন এলাকার বাসিন্দারা যেন নিশ্চিন্তে রাতের ঘুম কাটাতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাত জেগে নিজের গাঁটের টাকায় কেনা গাড়ির তেল খরচ করে পুলিশ ডিঊটি করে অন্যের নিশ্চিন্ত ঘুম নিশ্চিত করে!
আমি যখন থানায় দায়িত্বে ছিলাম, তখন থানায় একটা সরকারী গাড়ি বরাদ্দ ছিলো। সেই গাড়ির জন্য প্রতিদিন ১০ লিটার তেল সরকারী বরাদ্দ ঠিকই ছিলো। কিন্তু সকাল বিকাল চার খানা মোবাইল ডিঊটি সহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা বেসরকারি গাড়ির জন্য এক ফোঁটা তেল বরাদ্দ ছিলো না। অবশ্য সরকারী গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ির জন্য তেল বরাদ্দের সুযোগই নেই। শুধু তেল, স্টেশনারী, থানায় আসা লোকজনের নাস্তা বাবতই খরচ হয়ে যেতো ...।
অন্য কথায় আসি। আপনি যদি পৈশাচিক কায়দায় দিন দুপুরে হত্যা করা পুলিশ কনস্টেবলের বিষয়ে আলোকপাত করেন, আমাদের কষ্ট কিন্তু অন্য যায়গায়। আচ্ছা, একজন কনস্টেবলের বেতন কত, কেউ জানেন? কেউ কি জানেন রাত দিন কঠোর পরিশ্রম করা পুলিশ সদস্যদের খাবারে মেন্যুতে কি কি থাকে? শুনলে অবাক হবেন দেশের যত পুলিশ লাইন, থানা, ফাড়ি আছে কোথাও একজন পুলিশ সদস্য তার তিন বেলার খাবারের পেছনে দৈনিক ১০০ টাকার বেশী খরচ করতে পারেন না। শতকরা ৯৫ জন পুলিশই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, ফলে থানার বা পুলিশ লাইনের মেস এর খাবারই ভরসা তাদের। বাড়িতে পরিবারের খরচ বাদ দিয়ে নিজের জন্য এর বেশী খরচ তারা করে উঠতে পারেন না। আমি যখন থানার দায়িত্বে ছিলাম, তখন থানার মেস এর দৈনিক বিল আসতো ৭৩ টাকার মত। একবার ভাবুন, একশত টাকায় তিনবেলা খাবার খেয়ে পুলিশ সদস্যরা কতটুকু শারিরিক ভাবে সামর্থ্যবান হবেন?
রাজনৈতিক হানাহানির ডিঊটি গুলিতে পুলিশ সদস্যদের গায়ে চড়াতে হয় ৫ কেজির বুলেট প্রুফ, দুই কেজির হেলমেট, লেগ গার্ড, সাথে থাকে কয়েক কেজির লম্বা অস্ত্র শস্ত্র। এতকিছু গায়ে চড়িয়ে টানা ১২ ঘণ্টা হরতাল ডিঊটি, মিছিল মিটিং ডিঊটি, রোদ, ঝড় বৃষ্টিতে। যে পুলিশ সদস্যকে শকুনিরা পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেতলে, কুপিয়ে মেরেছে, তিনি আসলে দলছুট ছিলেন। এই পুলিশ সদস্য কি দিনে দিনে নিম্ন মানের খাবার খেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছিলেন, নাকি প্রায় দশ কেজির অতিরিক্ত মালামাল শরীরে বইতে বইতে ক্লান্ত, অবসন্ন ছিলেন, নাকি দীর্ঘদিন রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে ডিঊটি করতে করতে অসুস্থতায় ভুগছিলেন? নইলে অন্যরা কোন মতে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও তিনি কেন পারলেন না?
আচ্ছা তিনি কি মৃত্যুর আগে হামলাকারীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন তাকে এতটা নির্মমভাবে মরতে হচ্ছে, তার কি অপরাধ? তিনি কি তাদের আর্তস্বরে জানাচ্ছিলেন, আমার একটা ছোট মেয়ে আছে, সারাদিনের কষ্টকর ডিউটি শেষ করে তার কাছে ফিরে যাবার জন্য তিনি কথা দিয়ে এসেছেন?
পুলিশে হাড়ভাঙ্গা খাটুনী, কতশত বঞ্চনার পরেও শুধুমাত্র এই মেয়েটাকে মানুষ করার জন্যই তাকে দশ কেজির উপরে ভার বহন করে হলেও এই ডিঊটি করতে আসতে হয়েছে। নেকড়ের দল, তার কোন কথাই শোনেনি। মৃতে্যুর কোলে ঢলে পড়ার পরেও তারা তাকে কুপিয়েছে, আঘাতের পর আঘাত করে গেছে। নরকের কীটগুলি একজন আমিরুলকেই প্রক্যশ্যে নির্মমভাবে মেরে ফেলেনি, তারা একটা  স্বাধীন রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীকে ভুলুন্ঠিত করে আঘাতের পর আঘাত করে গেছে। যতদিন এই রাষ্ট্র বেঁচে থাকবে, এই রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী সর্বদা তাদের মান মর্যাদাকে এইভাবে রাজধানীর বুকে প্রকাশ্য দিবালোকে মার খেয়ে যেতে দেখবে, স্মরণে রাখবে। বর্বরেরা সেদিন অসংখ্য পুলিশ সদস্যদের একই কায়দায় পিটিয়েছে, কুপিয়েছে, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গেছে, পকেটের মানি ব্যাগ, মোবাইল নিয়ে গেছে, কারো মাথা থেতলে দিয়েছে, কাউকে রড লাঠি দিয়ে মেরে মেরে হাত পা গুড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি তারা যেন চিকিৎসা নিতে না পারে সেজন্য সারাদেশের মধ্যে একমাত্র পুলিশের হাসপাতাল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ভেতরের খবর, বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য কোমায় আছেন, বেশ কয়েকজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন।
২০১৩ ও ২০১৪ সালেও একই কায়দায় শ খানেক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে, পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, করোনাতেও ১১৭ জন মরলো। এ কেমন চাকুরী? অন্য সরকারী চাকুরেরা শুধু শুক্র শনিবার হিসেব করলে বছরে ৫২ সপ্তাহে সাড়ে তিন মাস এমনি ছুটি পায়। আরও আছে, ঈদ, পুজো, পার্বন, রমজান, হরতাল, এমনি ১২ মাসে প্রায় ৫ মাসের ছুটি। সে জায়গায় পুলিশ পায় বছর জুড়ে মাত্র ২০ দিনের ছুটি। সেটা পেতেও কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। ছুটি না পেয়ে অনেকে পুলিশ আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। অন্য চাকুরেরা সবাই দিনে ৮ ঘণ্টার কাজ করেন। পুলিশের ঘণ্টার শুরু আছে, শেষ নেই। আপনি সকাল ৯টায় গেলেও ওসি কে থানায় উপস্থিত চাইবেন, রাত ৩/৪ টায় ও চাইবেন যেন আপনার ফোন ধরে। ব্যস্ততার কারণে পুলিশের বন্ধু বান্ধব হারিয়ে যায়, আত্নীয়-স্বজন হারিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাদের পুলিশ বাবা, ভাই-সন্তানদের দেখা পান মাসে দু এক দিনের জন্য, হঠাৎ।
আমি বলতে চাই না সকল পুলিশই ফেরেশতা, ভালো মানুষ। কিন্তু দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে এসে তাদের অনেকেই কেন এমন করে আচরণে, মননে এতটা পরিবর্তিত হয়ে যায়? আপনাদের কি মনে হয় না, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে, দিনের পর দিন শুধু পরিশ্রম আর পরিশ্রম করতে গিয়ে, নানা অসহনীয় মানসিক চাপ বইতে গিয়ে, পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে থেকে, নিম্ন মানের অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে খেয়ে, দেশের অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই শুধু শারিরিক ভাবেই নয়, মানসিকভাবেও অসুস্থ!
পুলিশের অবৈধ সম্পদ এর কথা যদি ভাবেন, আগে আপনার এলাকায়, চারপাশে খোঁজ নেন কয়টা অট্টালিকা পুলিশ সদস্য কারো নামে আছে। অন্য পেশার লোকজনের কয়টা আছে? অনুপাতটা কি এক লক্ষ অনুপাত এক হবে?  না ঢের বেশী? মিলিয়ে নিন। আমি হয়তো গণিতে অপারদর্শী নই। আড়াই লক্ষের বিশাল বাহিনীর মাধ্যে কিছু দুষ্ট মানুষ আছে ঠিকই, কিন্তু  সভ্য বলে যারা নিজেদের আত্ম অহমিকা নিয়ে গর্বিত ভাবেন, তারা প্রকাশ্যে রাজধানীর সড়কে আদিম উন্মত্তায় মানুষ খুনের বিষয় নিয়ে এক চুল ভাবান্তরিত হতে দেখলাম না। তাদের মুখে রা নেই কেন? বর্বরতার সংজ্ঞা কি, আরো কিছু কি যোগ করতে হয়?
এই বাহিনীর সদস্যরাই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা। প্রথম শহীদ, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে রাতে কাপুরুষের দল হামলে পড়েছিলো, সে রাতেও প্রথম শহীদ একজন পুলিশ সদস্য। এত বঞ্চনা এত শ্রম, এতসব ত্যাগ। কিন্তু পুলিশের কোন বীর শ্রেষ্ঠ নেই, বীর উত্তম নেই, স্বীকৃতি নেই। কেউ প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশকে ইট দিয়ে মাথা থেতলে দিয়ে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করলেও বিচার নেই।
বিপদে পড়লে এদের দিয়েই কর্ম হাসিল, পরে ছুড়ে ফেলা!
দিদারুল ফেরদৌস
পুলিশ কর্মকর্তা

Side banner