নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৮৭১ সালের ৭জুন, ঢাকার নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নবাব খাজা আহসানুল্লাহ।
ছোটবেলা থেকেই নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন উদার মনের মানুষ। তিনি শুক্রবার দিন বাবার সাথে শাহী মসজিদে জুম্মা-নামাজ পড়তে যেতেন। মসজিদে গিয়ে তিনি মুসল্লিদের জুতা পাহারা দিতেন। এছাড়া তিনি বাসার চাকর-বাকরদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন এবং রাতে তাদের সঙ্গে ঘুমুতেন। তিনি পরিবারের রেওয়াজানুযায়ি জরীর পোশাক না পরে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তিনি ধনী-গরীব সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন।
১৮৯৩ হতে ১৮৯৫ পর্যন্ত তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন। প্রথমে তিনি যোগদান করেন ময়মনসিংহে। তার বাসাতে সাধারণ জনগণ কেন ঘনঘন আসা-যাওয়া করে, সেই অভিযোগে তাকে বদলি করা হয় বিহারে, তারপর ত্রিপুরায়। ঘনঘন বদলির ফলে তিনি বিরক্ত হয়ে দুবছর পার না হতেই সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বাঙালি জাতির ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জনের অনুমতিক্রমে অখণ্ড বাংলাকে ভাগ করেন। আসাম ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত হয় নতুন প্রদেশ। ঢাকাতে হয় এর রাজধানী।
১৯০৬ সালের ২৮,২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ঢাকার শাহবাগে নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতির ২০তম সভাটি বিচারপতি শরফুদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপমহাদেশের দেড়হাজার ডেলিকেটসহ পাঁচ শতাধিক সাধারণ জনগণ। সেদিন ৩১টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৩০ ডিসেম্বর নবাব স্যার সলিমুল্লাহর প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য নবাব ভিকার-উল-মূলক-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর তার দীর্ঘ বক্তৃতায় মুসলিম লীগ অল কনফেডারন্সি গঠনের কারণ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা দিয়ে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় হাকিম আজমল খানের সমর্থনে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ দলের নাম সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে নামকরণ করেন 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ'। ৩৯ সদস্য বিশিষ্ট এ সংগঠনের মূল উদ্যোগক্তা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ হলেও নিজে হন ৬ষ্ঠ সহ-সভাপতি। সভাপতি নির্বাচিত হন স্যার আগা খান এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান বিলগ্রামি।
বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনটি নতুন প্রদেশের সচিবালয়ের জন্য ১৯০৪ সালে নির্মিত হয়। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ার পর ১৯২১ সালের ১ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৩৬ সালের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই, এটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তরিত হয়।
বর্তমানের বঙ্গভবনটি ১৯০৪ সালে ১৭৫ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ছিল ঢাকার নবাবদের বাগান বাড়ি। বিল্ডিং নির্মিত হওয়ার পর ১৯০৫ সাল থেকে এখানে নতুন প্রদেশের লেঃ গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু করেন। এটিকে তখন বলা হতো লাটভবন। বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ার পর ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্ট পর্যন্ত বলা হতো বঙ্গ প্রদেশের দ্বিতীয় রাজধানী গভর্নর হাউজ। ১৯৪৭ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত এটির নাম ছিল পূর্বপাকিস্তান গভর্নর হাউজ এবং ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি হতে এটির নামকরণ হয় বঙ্গভবন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর নতুন প্রদেশের ব্যাপক উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু হয়। বিশেষ করে স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ব্রিটিশ ভারতের সরকার ১৯০৮ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নতুন প্রদেশের প্রতিটি জেলাতে ১০টি করে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং এসব প্রতিষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেয়েরা লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল। সেই সঙ্গে প্রতিটি জেলায় একটি করে টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট চালু করা হয়। শুধু তাই নয়, যেসব মহিলা ঘরে বসে শিক্ষা লাভ করতো তাদেরকে সার্টিফিকেট দেওয়া হতো।
কিন্তু এ সুখ এদেশের মানুষের ভাগ্যে বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কলকাতার হিন্দু কংগ্রেসি নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্ব, দিল্লিতে ব্রিটিশ ভারতের সম্রাট পঞ্চম জর্জ এক ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে দেন। সেই সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করা হয়।
বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্যার সলিমুল্লাহর অসুস্থতার খবর শুনে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় আসেন। একদিন সকালে স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও ধনবাড়ির জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী লর্ড হার্ডিঞ্জের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই স্যার সলিমুল্লাহ লর্ড হার্ডিঞ্জকে প্রতিশ্রুতি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত জমি দান করবেন। তারপর ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে লর্ড হার্ডিঞ্জকে ঢাকাতে জাঁকজমক ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিনই লর্ড হার্ডিঞ্জ বঙ্গভঙ্গ রদ-এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিার প্রতিশ্রুতি দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নাথান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে এটির কার্যক্রম কয়েক বছর স্থগিত ছিল। তারপর ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজেসলেটিভ কাউন্সিল অধিবেশনে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সকল সদস্যের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিল পাসের আহ্বান জানান। এরমধ্যে স্যাডলার কমিশনের ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ, ভারতীয় আইনসভা কর্তৃক পাস হয় 'দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি আ্যাক্ট ১৯২০'
অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উঠলে কলকাতার হিন্দু কংগ্রেসি নেতাসহ বুদ্ধিজীবীরা চরমভাবে এর বিরোধিতা করতে থাকে।
১৮৮৫ সালে আ্যলান অক্টোভিয়ান হিউম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করলে দলটির নেতৃত্ব হিন্দুদের হাতে চলে যায়। ফলে ১৯০৬ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দলটির নেতৃত্ব মুসলমানদের হাতে ন্যস্ত হয়। সেই কারণে অনেকে মন্তব্য করে থাকেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন। কার্যত তিনি কখনোই হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। ১৯০৫ সালে ভারতের গুজরাটের সন্তান ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপলের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ। ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্টে উপমহাদেশ দুই ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তির পর ঢাকাতে এর শাখা চালু হয়।
১৯০২ সালে স্যার সলিমুল্লাহ তার বাবার নামে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে এটিকে উন্নীত করে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ করা হয়। তারপর ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার এটির নামকরণ করে পূর্বপাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর নামকরণ হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ধনবাড়ির জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই,তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০জন শিক্ষক, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ও ৩টি আবাসিক হল নিয়ে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ততোদিন বেঁচে ছিলেন না। তিনি ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি, মাত্র ৪৩ বছর ৭ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন।
তিনি ছিলেন জনদরদী, দেশপ্রেমিক ও দানবীর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ এতিমখানাসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেই সঙ্গে উল্লিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের মানুষের কল্যাণে ৬০০ একর জমি দান করে গেছেন। এই মহান মানুষটির সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে জাতিকে উপহার দিলে শত শত সলিমুল্লাহ এদেশে সৃষ্টি হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
শাহজাহান আবদালী
কবি ও রম্যলেখক
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা।
আপনার মতামত লিখুন :