Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫, ১১ কার্তিক ১৪৩২

যমজ ৫ নবজাতক নিয়ে অর্থকষ্টে লামিয়ার পরিবার


দৈনিক পরিবার | স্টাফ রিপোর্টার অক্টোবর ২৬, ২০২৫, ১১:৩৭ এএম যমজ ৫ নবজাতক নিয়ে অর্থকষ্টে লামিয়ার পরিবার

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আলোকী চাঁদকাঠী গ্রাম। দক্ষিণের এই প্রত্যন্ত গ্রামের একচালা ঘরেই অবস্থান করছে পাঁচটি শিশু। তিন ছেলে আর দুই মেয়ের মা তেইশ বছরের লামিয়া আক্তার। কোনো অপারেশন ছাড়াই বরিশালের একটি বেসরকারি হাসপাতালে একসঙ্গে পাঁচ নবজাতকের জন্ম দিয়েছেন।
৬ অক্টোবর পাঁচ নবজাতক জন্মের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ছোট্ট গ্রামটি যেন পরিণত হয়েছে উৎসবে। পাঁচ নবজাতক সন্তান নিয়ে ১২ অক্টোবর লামিয়া তার বাবার বাড়ি পৌঁছান। প্রতিদিন শতাধিক মানুষ ছুটে আসছেন লামিয়ার বাবার বাড়িতে নবজাতকদের একনজর দেখার জন্য। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এমনকি দূরের মানুষও কৌতূহল নিয়ে আসছেন। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন, কেউ বা গল্প করছেন চায়ের দোকানে। কিন্তু ঘরের ভেতর অন্য চিত্র। বাইরে আলো আর কোলাহল, ভেতরে নিঃশব্দ কষ্ট। নবজাতকদের খাবার অনিশ্চিত, ঋণের বোঝা দিন দিন ভারী হচ্ছে।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আলোর মতো জন্ম নেওয়া এই পাঁচ নবজাতকের পাশে এখন শুধু কান্নার শব্দ। পরিবারের একটাই চাওয়া, তাদের জীবনের বিনিময়ে যেন এই আলোগুলো টিকে থাকে, অকালেই ঘরের প্রদীপের মতো নিভে না যায়। দক্ষিণের সবচেয়ে বড় বাজার কালিশুড়ি। এই বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমারখালী নদী, এখন প্রায় খালের মতো চিকন হয়ে যাওয়া ক্ষীণ প্রবাহ। নদীর ওপারের সেই গ্রামেই জন্ম নিয়েছে পাঁচ নবজাতক।
বৃহস্পতিবার সকালে কুমারখালী বাজারে পৌঁছলে দেখা যায় চায়ের দোকানে আলোচনার ঝড়। দোকানি আলমগীর হেসে বললেন, একসঙ্গে পাঁচটা বাচ্চা! এমনটা তো শুধু গল্পেই শুনেছি। এবার নিজের চোখে দেখে এলাম।
প্রতিদিন শতাধিক মানুষ ভিড় করছেন লামিয়ার বাবার বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, দূর-দূরান্তের মানুষ— সবাই দেখতে চান সেই পাঁচ শিশু। কিন্তু সেই ভিড়ের মাঝেই লামিয়ার বিশ্রাম নেই। পাঁচ সন্তানকে বুকের দুধ, ঘুম পাড়ানো, ওষুধ আর কান্নার ফাঁকে সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত শরীর। 
লামিয়ার মা শাহনাজ বেগম বলেন, রাত-দিন এক করে মেয়েটা শুধু বাচ্চাগুলারে দেখতেছে। ওর চোখে ঘুম নাই।
লামিয়া এখন বাবার বাড়িতে। বাবা ফারুক হাওলাদার ইটভাটার শ্রমিক, মা শাহনাজ গৃহিণী। ঘরে নবম শ্রেণিতে পড়া এক ভাই। 
ফারুক বলেন, গাছ বিক্রি কইরা, ঋণ কইরা মেয়ের জামাইরে ৯০ হাজার টাকা দিছি। এখন খরচে খরচে মাথা ঘুরতেছে।
বরিশাল ডায়াবেটিস হাসপাতালে চিকিৎসা, শেরবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওষুধ ও থাকার খরচ, সব মিলিয়ে দেড় লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন প্রতিদিন শুধু প্যাম্পারসেই খরচ পাঁচ শ টাকা। গুঁড়া দুধ প্রায় শেষ। লামিয়া নিজেও দুর্বল, ফলে শিশুদের বুকের দুধ দিতে পারছেন না।
মা শাহনাজ বেগম হতাশার কণ্ঠে বলেন, নতুন করে কোনো এনজিও টাকা দেয় না। গাছ নাই, বিক্রি করব কী?
কুমারখালী বাজার ও আলোকী চাঁদকাঠী গ্রামে এখনো কানাঘুষা চলছে। জামায়াতের ঘোষিত প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মাসুদ নাকি এই পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন, দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। স্থানীয় ইউপি সদস্য ইউনুস হাওলাদার বলেন, ‘মানুষ ভাবতেছে, তারা টাকা পাইছে। এই জন্য কেউ এক টাকাও দিচ্ছে না। আসলে তারা আগের চেয়েও বিপদে।’
কিন্তু সত্যিটা আরো করুণ। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের একদল স্টাফের মাধ্যমে মাত্র ১০ হাজার টাকা এসেছিল পরিবারটির হাতে। সেই সামান্য সাহায্যই এখন গুজবে ১০ লাখ টাকায় ফুলে উঠেছে।
লামিয়ার স্বামী সোহেল হাওলাদার বলেন, ‘এই ১০ হাজার টাকায় আমাদের পরিবারে দূরত্ব তৈরি করেছে। আত্মীয়রাও এখন পাশ ফিরে দেখে না। কেউ ভাবে আমরা টাকা পাইছি, কেউ ভাবে আমরা মিথ্যা বলতেছি।’ 
চোখের কোণে জল নিয়ে তিনি আরো বললেন, ‘আমরা একবেলা না খেয়ে থাকতে পারি, কিন্তু বাচ্চাগুলোর তো সেটা চলে না।’
একসময় যে কুমারখালী নদীতে নৌকা চলত অবসরে, এখন সেই খেয়াতেই যাত্রীর ভিড়। নৌকার মাঝি হাসতে হাসতে বলেন, ‘পাঁচ বাচ্চা যেদিন আইছে, সেদিন থেইকা খেয়াপাড়ে ভিড় লাগছে। আগে দিনে দশজন যেত, এখন অর্ধশত মানুষ শুধু ওই বাচ্চাগুলারে দেখতে আসে। লামিয়ারের বাচ্চাগুলা আমারও ভাগ্য ঘুরাইছে।’
লামিয়ার নানা মকবুল হোসেন খান বললেন, দাঁত দিয়েছেন যিনি, ভাতও দিবেন তিনি। তার কণ্ঠে মিশে আছে বিশ্বাস আর অসহায়তা। 
তিনি জানান, কয়েকজন মানুষ নবজাতকদের দত্তক নিতে চেয়েছিলেন, বিনিময়ে টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ের পরিবার রাজি হয়নি। এমন তথ্য দিয়ে মকবুল বললেন, ‘আমার মেয়ের পরিবার গরিব ঠিকই, কিন্তু মনের জোর বড়।’
লামিয়ার মা শাহনাজ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন, তারপর বললেন ‘মেয়ের বিয়া হইছে পাঁচ বছর, বাচ্চা নাই। এখন আল্লাহ মুখ তুলে তাকাইছে। কিন্তু যদি মাইয়াডা বাঁচে, তবেই বাচ্চাগুলারে বড় করতে পারবে।’
বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, সোহেলের পরিবারের পাশে আমরা সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু তার বাড়ি বরিশাল জেলার বাইরে হওয়ায় আমরা সেভাবে সহযোগিতা করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করছি, সোহেলের পরিবার যাতে নবজাতকদের নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারে। 
ফারুক হাওলাদারের বাড়িতে তিন ভাই এক ছাদের নিচে থাকেন। সেই ঘরে এখন সব সময় মানুষের আনাগোনা। মশারির ভেতর পাঁচটি ছোট প্রাণ। বাইরের লোক আসে, দেখে যায়, কিন্তু রেখে যায় না কিছু। ঘরের ভেতরে আলোর ঝলকানি নেই, আছে শুধু কোলাহল আর কান্নার সুর। পাঁচটি নবজীবনের আলো জ্বালাতে গিয়ে নিভে যাচ্ছে ঘরের প্রদীপ, সেই আতংকে আছে পরিবারটি।

Side banner