ঢাকা শহরের আকাশে ভেসে চলা মেট্রোরেল আজ শুধু স্বপ্ন নয়, এ যেন সভ্যতার এক চলমান প্রতীক। গতি, স্বাচ্ছন্দ্য ও সময়ানুবর্তিতার মেলবন্ধনে এই আধুনিক গণপরিবহন ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রায় এনেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।
আমি বিশ্বাস করি, মেট্রোরেল শুধু শহরের চাকা নয়, এটি হতে পারে চিন্তারও চাকা; যদি প্রতিটি স্টেশনে স্থাপন করা যায় একটি বিনামূল্যের বইয়ের তাক, বা ‘ফ্রি বুক শেলফ। ছোট এই শেলফে থাকবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত বই- যে কেউ পড়বে, রেখে যাবে কিংবা নিজের বইটি রেখে যাবে অন্যের জন্য। বইগুলো হবে আমাদের সবার, ঠিক যেমন মেট্রোরেলও আমাদের সবার। যাত্রীরা চাইলে বই নিতে ও রেখে যেতে পারবেন। কর্তৃপক্ষ কেবল প্রথম ধাপে শেলফ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই যথেষ্ট। বাকি কাজটি করবে নাগরিকরাই।
ঢাকাবাসীর প্রতিদিনের জীবনে সময় যেন এক বিরল সম্পদ। যানজটের নগরে মানুষ ঘন্টার পর ঘণ্টা হারিয়ে ফেলত কিন্তু মেট্রোরেল সেই সময় ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই বাড়তি সময়টুকু যদি কাজে লাগে একটি বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়তে, তবে এটি শুধু সময়ের সাশ্রয় নয় এটি বই ও মেট্রোরেলের মধ্যকার এক নিঃশব্দ সংলাপ, এক নীরব সাংস্কৃতিক জাগরণ।
এই ধারণার তিনটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- ১. পড়ার অভ্যাসের পুনর্জাগরণ; মেট্রোরেলের আরামদায়ক পরিবেশে হাতে যদি ধরা যায় একটি বই, তা মানুষকে মোবাইল স্ক্রিনের নেশা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিতে পারে। প্রতিদিনের ৩০-৫০ মিনিটের যাত্রা বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা উল্টে দিতে যথেষ্ট। এভাবে যাত্রা পরিণত হবে জ্ঞানের অভিযাত্রায়। ২. মানসিক প্রশান্তি ও বিনোদন; যাত্রাপথে একটি গল্প, একটি কবিতা, কিংবা একটি অনুপ্রেরণামূলক প্রবন্ধ— মনকে করে তুলতে পারে সজীব ও হালকা। ক্লান্ত কর্মজীবনের মাঝে এটি হতে পারে শান্তির এক মুহূর্ত। ৩. কমিউনিটি বিল্ডিং ও বই বিনিময়; বুক এক্সচেঞ্জ’ বা ‘বুক ক্রসিং’ ধারণাটি নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বন্ধন তৈরি করতে পারে। কেউ বই রেখে যায়, কেউ নেয় কেউ না কাউকে পাঠায় একটি ভাবনার বার্তা। বই হয়ে ওঠে সংলাপের সেতু, অচেনা মানুষ হয়ে ওঠে এক পাঠকমাত্র বন্ধন।
বিশ্বের নানা দেশে গণপরিবহন শুধু যাতায়াত নয়, জ্ঞানেরও কেন্দ্র হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক প্রেরণা রয়েছে। জার্মানিতে ‘পাবলিক বুককেস’ অত্যন্ত জনপ্রিয়, রেলস্টেশন, বাসস্টপ বা পার্কে রাখা এসব বুকশেলফ থেকে মানুষ বিনামূল্যে বই নেয় ও রেখে যায়। রাশিয়ার মস্কোয় চলছে ‘ফ্রি বুক-ক্রসিং’ আন্দোলন সরকারি সেবা কেন্দ্রেও বই বিনিময়ের তাক রাখা হয়। লন্ডনের টিউব স্টেশনে ‘রিড অ্যান্ড লিভ’ প্রচারণায় মানুষ বই রেখে যায় পরের পাঠকের জন্য। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রয়েছে ‘লিলিপুট লাইব্রেরি’ বাড়ির বাইরে ছোট কাঠের কেবিনেট, যার প্রতিটি যেন জনমানুষের ক্ষুদ্র পাঠাগার। বিশ্বসেরা বুকশপ কিনুকুনিয়া জাপানের বিনিয়োগ। জাপান বইপ্রীতির জন্য বিশ্ববিখ্যাত। মেট্রো স্টেশনে ছোট গল্পের ডিসপেনসার, পুরোনো ট্রেনকোচকে লাইব্রেরিতে রূপান্তরের মতো উদ্যোগে তারা পড়াকে সংস্কৃতির অংশে পরিণত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তো বই পড়া গণপরিবহনের এক স্বাভাবিক দৃশ্য। নিউ ইয়র্ক, বোস্টন কিংবা শিকাগো, যেখানেই যান, দেখবেন যাত্রীরা কিন্ডল বা বই হাতে নিমগ্ন।
এমনকি হলিউড অভিনেত্রী এমা ওয়াটসনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও ভারতের মেট্রোতেও বই বিনিময়ের আন্দোলন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দিল্লি মেট্রোর ‘বুক ফেয়ারি’ স্বেচ্ছাসেবীরা গোপনে বই রেখে যান যাত্রী তুলে নেয়, পড়ে, আবার অন্য কোথাও রেখে আসে। এক মায়াময় সাংস্কৃতিক বিনিময়।
বাংলাদেশেও পাঠপ্রবণতার নতুন উন্মেষ ঘটছে। প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নেতৃত্বে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি গত ২৬ বছরে দেশের ৬৪ জেলায় পৌঁছে দিয়েছে পড়ার আলো, গড়ে চলছে আলোকিত মানুষ, আলোকিত দেশ।
পিবিএস, পাঠক সমাবেশ, বেঙ্গল, বাতিঘর, প্রথমা, বুকওয়ার্ম, বুক এন্ড বা ঋদ্ধি বুক ক্যাফে সবগুলোই শহুরে পাঠসংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রতীক।
প্রমথ চৌধুরীর ‘বই পড়া’ ও মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধের পর যে বইবিমুখতার অভিযোগ ছিল, সেটি আজ ইতিহাস। তবু পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের পেছনের সারিতে। ১০২ টি দেশের মধ্যে ৯৭ তম! যেখানে একজন আমেরিকান বছরে গড়ে ১৭টি বই পড়েন, সেখানে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় শূন্য দশমিকের কোঠায়। এ এক লজ্জার সত্য, কিন্তু একইসাথে পাঠ সংস্কৃতি গড়ে তোলার এক সম্ভাবনার আহ্বানও।
একটি ছোট পদক্ষেপই হোক এক বিশাল পরিবর্তনের পটভূমি। ঢাকা মেট্রোর প্রতিটি স্টেশনে যদি ছোট একটি কাঁচের বুক শেল্ফ বসানো যায়, প্রথম দিকে অনুদান হিসেবে বই সংগ্রহ করা যায়, তাহলে ধীরে ধীরে এটি নিজেই টিকবে যাত্রীদের অংশগ্রহণে। শিশুদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস সব বয়স ও রুচির পাঠকের জন্য উপযোগী বই থাকলে এটি হয়ে উঠবে নগরজীবনের এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
বড় কোনো অর্থনৈতিক বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু একটি সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত, একটি রেনেসাঁ! মেট্রোরেল যদি পরিবহনের দিগন্ত খুলে দিতে পারে, তবে সে পারে পাঠ-সংস্কৃতিরও নতুন জানালা খুলতে।
আমি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ভ্রমণের সময় মেট্রোতে মানুষকে কিন্ডল বা ই-রিডার ও বই পড়তে দেখেছি, হায়দ্রাবাদ ও কলকাতা এয়ারপোর্টে অনেকের হাতেই বই দেখেছি! হলিউডের বিভিন্ন সিনেমাতেও যাত্রাপথে বই পড়ার দৃশ্য অবলোকন করেছি। শখে একটি কিন্ডলও কিনেছি!
ঢাকা মেট্রোরেল হোক আমাদের শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোর সেতু নয়, বরং জ্ঞানের সিঁড়িও। প্রতিটি স্টেশনের ছোট্ট বুকশেলফ আমাদের মনে করিয়ে দিক, আমরা শুধু যাত্রী নই, আমরা পাঠকও।একটি বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে শুরু হোক নাগরিক আলোর যাত্রা। আলোর পথে বাংলাদেশ!
মেট্রোরেলের কামরায় বইয়ের ঘ্রাণে মিলুক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ঢাকা হোক শুধু চলমান শহর নয়, চলমান পাঠশালা।
উন্নত দেশগুলো গণপরিবহনের ক্ষেত্রে এই ধারণাটি সফলভাবে ব্যবহার করেছে, যা বাংলাদেশের মেট্রোরেলেও একটি সুন্দর ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে, এনে দিতে পারে নতুন পরিচয়। মেট্রোরেল হোক জ্ঞানের সিঁড়ি। আমার এই ছোট্ট স্বপ্ন বা ধারণা মেট্রোরেলের এই “পড়ার জগৎ” একদিন ঢাকা শহরের নাগরিকদের কাছে এক গর্বের প্রতীক হয়ে উঠবে, জাতীয় চরিত্রে বই পড়ার তকমা লাগবে, বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো আমরা! এই প্রত্যাশা করি।
লেখক: মীর হালিম
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, পলিসি অ্যানালিস্ট ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি), বাংলাদেশ।








































আপনার মতামত লিখুন :