ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে আর ছয় মাস পর আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগেই বহু প্রত্যাশিত এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গতকাল বুধবার এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে চিঠিও নির্বাচন কমিশনে পৌঁছে গেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে দোদুল্যমানতার অবসান হওয়ায় গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিজয় র্যালি করেছে।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন পেতে নানামুখী যোগাযোগে ব্যস্ত। অন্য দলগুলোর নির্বাচনমুখী তৎপরতা বেড়েছে। দলগুলোর প্রত্যাশা এবং কিছু ক্ষেত্রে হতাশা এ নির্বাচন ঘিরেই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গতকাল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বৈঠক করেছেন।
এদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা আমাদের এক মাসের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়াসহ অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করব। অনেক আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার জন্য আমরা আমাদের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছি।’
সিইসিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে চিঠি : গত রাত পৌনে ৯টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন সচিবকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
এই চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে উল্লিখিত সময়ে প্রত্যাশিত মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। চিঠিতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে অবিলম্বে এ ক্ষেত্রে সব প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরুর কথা বলেছেন। গত ১৫ বছরে নাগরিকদের ভোট দিতে না পারার প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন যেন মহা-আনন্দের ভোট উৎসবের দিন হিসেবে স্মরণীয় হয় তেমন আয়োজনের ওপর প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন। চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে নির্বাচন আনন্দ-উৎসবে, শান্তি-শৃঙ্খলায়, ভোটার উপস্থিতিতে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতায় অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠার যে প্রত্যাশা করেছেন, তা উল্লেখ করা হয়।
নির্বাচন আয়োজনে যথোপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্বারোপের পাশাপাশি একটি প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রত্যয়ের কথাও নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়।
বেশির ভাগ দলই সময় নিয়ে সন্তুষ্ট : রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগই নির্বাচনের এই সময় নিয়ে সন্তুষ্ট। বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা বলেছেন, নির্বাচন আরো আগে হলে ভালো হতো। জামায়াতে ইসলামী জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে, এমন ধারণা নিয়ে কয়েক মাস আগেই দলটি অন্তত ২৯৬ আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রস্তুত করেছে। ধাপে ধাপে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য এসব প্রার্থীর নাম অনানুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। গণসংযোগ বাড়াতে এসব প্রার্থী তৎপর।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন যে সময়ের কথা বলা হয়েছে তাতে আমাদের আপত্তির কোনো জায়গা নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে সংস্কারকে দৃশ্যমান করা ও সংস্কার বাস্তবায়ন করা এ সরকারের অবশ্য কর্তব্য।’ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জুলাই ঘোষণাপত্রে কিছু ঘাটতি উল্লেখ এবং তাদের দাবি অনুসারে পিআর পদ্ধতি উপেক্ষিত হওয়ায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছে, ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনীতি করে। আমরা সব সময় সম্ভাবনাকে বড় করে দেখি। আমরা নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রস্তুতিও চলমান।’ ইসলামী আন্দোলন এরই মধ্যে বেশ কিছু আসনে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে রেখেছে। গত ২৮ জুলাই রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগের সংসদীয় আসনের প্রাথমিক বাছাইয়ে নির্ধারিত প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপির সমমনা বিভিন্ন দল, ১২ দলীয় জোট, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, এবি পার্টি এসব দল ও জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য জাতীয় নির্বাচন অত্যাবশ্যক, এর সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা জনজীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমরা মনে করি।’ এসব দল বড় কোনো জোটের শরিক হতে মনোযোগী বলে পর্যবেক্ষকমহলের ধারণা।
সিইসি যা বললেন: গতকাল দুপুরে নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছি। আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি হবে না। আমরা ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ করছি। বিশেষ করে যারা ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ বছর পূর্ণ করবে, তাদের নতুন ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে আইন সংশোধন করা হয়েছে। ভোটার রেজিস্ট্রেশন, প্রশিক্ষণ, প্রকিউরমেন্ট ইত্যাদি কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চাই।’
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি এবং তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিও চলছে। তফসিল ডিসেম্বরের শুরুর দিকে হতে পারে। রোডম্যাপ ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হবে। আমরা এক মাসের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়াসহ অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করব। মিডিয়ার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, মিডিয়া আমাদের সঙ্গে থেকে নির্বাচনকে আরো স্বচ্ছ করতে ভূমিকা রাখুক। আপনারাও (সাংবাদিক) আমাদের বড় স্টেকহোল্ডার।’
সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের বিষয় নিয়ে সিইসি বলেন, ‘এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমরা সাংবাদিকদের সহযোগী হিসেবে দেখি, শত্রু হিসেবে নয়। আপনাদের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে নীতিমালা সংশোধনের চিন্তা-ভাবনা করছি। শুধু নীতিমালা নিয়ে নয়, পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়েই আপনাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করব।’
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্র্নিধারণ সম্পর্কে সিইসি জানান, একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। আপত্তি ও শুনানি শেষে নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা হবে। নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনপ্রক্রিয়া চলছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও আপত্তি গ্রহণের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়া সেপ্টেম্বরের মধ্যেই শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।
সিইসি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। প্রশাসন, পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআই সবাইকে বলেছি, দলীয় পক্ষপাত ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। আগের মতো কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই, বরং এখন চাপ থাকবে পেশাদার ও নিরপেক্ষ কাজ করার। এখন এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। ভোটারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভোটাররা নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারিয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। রাজনৈতিক দল, ভোটার সবাই যেন নির্বিঘ্নে অংশ নিতে পারে। অতীতে অনেক দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, এবারও চাই আরো বেশি জনগণের অংশগ্রহণ। এ জন্য ম্যাসিভ অ্যাওয়্যারনেস ক্যাম্পেইন চালানো হবে। আমার বিশ্বাস, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। আমার জন্য এখন বড় দুশ্চিন্তা হয়ে গেছে এআইয়ের মিসইউজ ও অ্যাবিউজ। এটা রং ইনফরমেশন দিচ্ছে প্রতিদিন।’
গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে চিন্তা করছি। যারা পূর্বে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল, তারা যাতে নিরপেক্ষ থাকে তা নিশ্চিত করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। এখন কোনো ধরনের চাপ নেই, বরং যারা অনিয়ম করবে তাদের জবাবদিহি করতে হবে মানুষ, রাষ্ট্র ও আল্লাহর কাছে।’
আওয়ামী লীগের কোনো সদস্য নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘দল হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, তবে ব্যক্তিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে পারবেন। সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন। আমাদের উদ্দেশ্য একটি সুন্দর, বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন। সবাইকে নিয়ে আমরা নির্বাচন করতে চাই। জনগণের আস্থা ফেরানো, তাদের ভোটকেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ববোধ সবকিছুর সমন্বয়ে আমরা কাজ করছি।’
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা : জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) লটারির মাধ্যমে বদলি করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসন্ন সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা আলোচনা করেছি। নির্বাচনের সময় যে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা জানেন, ডিসি, এসপি, ইউএনও ও ওসি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনের সময় দেখা যায়, প্রার্থীরা তাঁর আসনে পছন্দের এসপি, ডিসি কিংবা ওসিকে চান। কিন্তু আমরা এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, গণমাধ্যমকে ডেকে সবার সামনে আমরা লটারি করব। লটারি অনুযায়ী নির্বাচনের আগে বিশেষভাবে এসপি ও ওসিদের পোস্টিং দেওয়া হবে। এখন সব কর্মকর্তা যেখানেই থাকুক না কেন নির্বাচনের আগে তাঁদের লটারির মাধ্যমে বদলি করা হবে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘নির্বাচনে ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রে একটি করে বডি ক্যামেরা দেওয়া হবে। পুলিশের সিনিয়র পোস্টে যিনি থাকবেন, তাঁর কাছে এই ক্যামেরা থাকবে । এ ছাড়া সব কটি বাহিনীকে আমরা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমাদের বাহিনীর প্রশিক্ষণের পর মহড়ারও আয়োজন করা হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :