৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী স্মরণে: আজ ৩০মে ২০২৪ ইং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী। বিনম্র শ্রদ্ধা।
১৯৩৬ সালে বগুড়ায় জন্মানো কমল ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া হিসেবে শাহাদাত বরণ করেন। কোটি কোটি মানুষের কান্নায় সেদিন বাংলার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, শোক প্রকাশ করেছিল বিশ্ববাসী। বাংলার জনগণ ভালোবেসে সেদিন থেকে তাকে শহীদ জিয়া নামেই অভিহিত করে থাকে। অনুসারীরা গর্ব করেই বলে থাকেন বাংলাদেশের অপর নাম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
মাত্র ৪৫ বছরের কর্মময় দুঃসাহসী জীবন । কমল বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হত ৮৮। এত কম সময়ে এত বেশি অর্জন এমন কর্মবীরের আগমন পৃথিবীতে কালে ভদ্রে ঘটে থাকে! চক্রান্তকারীদের হাতে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার সাথে সাথে বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা বেজেই চলেছে। আজ বাংলার মানুষ জীবনের মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য বস্ত্র অন্ন আর বাসস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে, পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষায়, নেতৃত্বে, হারিয়েছে ভোটাধিকার আর সেই সাথে ডুবে গেছে গণতন্ত্র।
এমন সংকটকাল অতিক্রম করার জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা, সততা, দেশপ্রেম, নেতৃত্বের কৌশল ও আদর্শ এই বাংলার মানুষের জন্য বাতিঘর। লাইট হাউস বা বাতিঘর যেমন করে নিরুদ্দেশ নাবিককে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় তেমনি জিয়াউর রহমানের জীবনাদর্শ যুগে যুগে কালে কালে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।
১৯৫৩ সালে ক্যাডেট হিসেবে তৎকালীন আর্মিতে যোগ দেওয়া কমলই পরবর্তীতে হন সেনা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দুঃসাহসিক অবদানের জন্য তৎকালীন আর্মির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব "হিলাল-ই-জুরত বা ক্রিসেন্ট অব কারেজ" লাভ করেন।
১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষণা করে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাধারণ বাঙ্গালীদের উপর "অপারেশন সার্চলাইট" নামে ইতিহাসের নৃশংস গণহত্যা চালায় তখন তিনি বললেন উই রিভোল্ট বা আমরা বিদ্রোহ করি। ২৬ মার্চে বেতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন ডিসেম্বর নাগাদ বিজয় অর্জন পর্যন্ত। সেদিন তিনি বলেন আমি বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক মেজর জিয়া এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় সাহসী অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব "বীর উত্তম" উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও একজন গর্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ রেংক "লেফটেন্যান্ট জেনারেল" সহ সেনাপ্রধান হিসেবে অবসরে যান। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করেন। জিয়ার এ রাজনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য উপাদান হিসেবেই বিবেচিত। কাল ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়ক!
১৯৭৭ সালে ডকট্রিন অব নেসেসিটির আওতায় সাংবিধানিক জটিলতা নিরসনে সামরিক আইন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে বহু দলীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং কূটনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন করেছিলেন জিয়া। আজকের আলোচনায় এই তিনটি বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমাজতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদী উদার অর্থনীতিতে রূপান্তর, জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা, প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণ, শিল্পের পুনর্গঠন ও বেসরকারিকরণ, ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা, বন্ডেড হাউস, ইপিজেড প্রতিষ্ঠা, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার মার্কেট চালু করন, রপ্তানির প্রসার,গার্মেন্টস শিল্পের সূচনা, কৃষিতে ভর্তুকি, উৎপাদনে গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন যাতে করে এদেশে সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ জিয়াই হলেন বাংলাদেশে উন্নয়নমুখী রাজনীতির রূপকার। অর্থনীতিবিদেরা তাকে প্রো-মার্কেট এবং লাইজেস ফেয়ার হিসেবে বিবেচনা করে।
যেসব বিষয় শহীদ জিয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অমর করেছে "বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ" তত্ত্বের উদ্ভাবন ও সফল ব্যবহার তার অন্যতম। পাহাড়ি বাঙালি জাতি উপজাতি হিন্দু মুসলিম সকলকে একই কাতারে এনে "বাংলাদেশি" হিসেবে পরিচিত করান। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যেই পরিচিতি আমাদের জন্য জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সেই সাথে তিনি সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস নীতি যোগ করেন। নিকট অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে সমন্বয় সাধন করার যেই কৌশলটি ব্যবহার করেছেন অনেকটা তার চেয়েও উন্নততর। অনেকটা বর্ণবাদ বিরোধী মার্কিন নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের "আমার একটি স্বপ্ন আছে" বক্তব্যের বাস্তবায়নের মতই।
বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল আমলের নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তিনি উন্মুক্ত করেন। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল অবাধ রাজনৈতিক কর্মসূচি করার সুযোগ পায় এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। রাজনীতিতে তার এই উদার মনোভাবের কারণে বাংলার জনগণ ভালোবেসে তাকে বহু দলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা বলে মানেন।
১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল যা জাগদল হিসেবে পরিচিত। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে যার পরিবর্তিত রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যা বিএনপি নামে সর্বাধিক পরিচিত ও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। ২৯৮ আসনের মধ্যে বিএনপির ২০৭, আওয়ামী লীগ ৩৯ (মালেক) ২ (মিজান), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট ২, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ১, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২, গণতান্ত্রিক লীগ ১ মুসলিম ডেমোক্রেটি লীগ ২০ অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বাকি ১৫ টি আসনে জয়লাভ করে। এভাবে তিনি বাংলার মানুষকে একত্রিত করে নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক রাজনীতি চালু করেন। এভাবেই আজকের ক্ষমতাশীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। কেননা বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ছিল না।
পররাষ্ট্রনীতিতে তার তিনটি কৌশলী পদক্ষেপ বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন করে পরিচিতি করায়। চীনের সাথে সম্পর্ক করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পুনর্গঠনের কাজ ত্বরান্বিত করেন। আমেরিকার সাথে সম্পর্ক করে আমাদের বিমান পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের আধুনিকীকরণ সম্পন্ন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক করার মাধ্যমে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছেন এবং আজকের বিশাল শ্রমবাজারের রূপরেখা বুনেছিলেন। তিনি গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে বাংলাদেশী অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য কর্মস্থলে রূপান্তর করেছেন। এই তিনটি দেশের সাথেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাদের কূটনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল ছিল।
এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু ভারত ও তার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যাতে সম্পর্ক নষ্ট না হয় সেজন্য তিনি আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিয়ে সার্ক প্রতিষ্ঠার রূপরেখা তৈরি করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক প্রতিষ্ঠায় স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এভাবে তিনি পররাষ্ট্রীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এসব অসামান্য দক্ষতা তাকে ক্রমেই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।
আরো বহু বিষয়ে ক্ষণজন্মা বাংলার রাখাল রাজা কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন যার প্রতিটি নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা গবেষণা করা যায়। ১৯ দফা কর্মসূচির সফলতা আজও গ্রাম বাংলার জনগণ ভোগ করে। তিনি ১৯৭৭ সালে একুশে পদক ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা "স্বাধীনতা পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার চালু করেন।
সেদিন ঢাকায় ১৯৮১ সালের ২ জুন বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে শত শত হাজার হাজার লোক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিল। আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর পাশে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে তাকে সমাহিত করা হয় যা জিয়া উদ্যান নামে পরিচিত লাভ করে।অনুসারী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সারা বছরই বিভিন্ন উপলক্ষে সমাধি সৌধে ফুল নিয়ে যান, আত্মার মাগফেরাত কামনা করন। ২০০৪ সালে বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৯ নম্বরে স্থান পান। জিয়াকে নিয়ে আরো বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন, তার আদর্শকে যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক করার জন্য অনুসারীরা সেই ব্যবস্থা করবেন বলেই বিশ্বাস করি। জিয়ার নামে শিক্ষাবৃত্তি চালু সহ পিএইচডির ফান্ডিং করলে লোকান্তরের জিয়ার প্রতিচ্ছবি এ বাংলায় আবার ফিরে আসবে! প্রজাপতি, রঙিন পাতা, ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, প্রিয় মাতৃভূমি, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
শহীদ জিয়ার আদর্শ, খালেদা জিয়ার আপোষহীন সংগ্রাম আর তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের নেতৃত্বে, বহুদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মাধ্যমে, স্থিতিশীল গণতন্ত্র কায়েম করা এবং সুষম জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আনয়নের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপির আপোষহীন আন্দোলন চলবে... অবিরাম। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই আজ জাতীয় লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কালে কালে যুগে যুগে বাতিঘরের মত এদেশে প্রাসঙ্গিক হয়েই থাকবে। শহীদ জিয়া অমর হোক। খালেদা জিয়া-জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য ও পাবলিক পলিসি অ্যানালিস্ট।
আপনার মতামত লিখুন :