Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা সোমবার, ০৬ অক্টোবর, ২০২৫, ২১ আশ্বিন ১৪৩২

অশ্রুজলে আহমদ রফিককে চিরবিদায়


দৈনিক পরিবার | নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ৪, ২০২৫, ০৩:২৬ পিএম অশ্রুজলে আহমদ রফিককে চিরবিদায়

আহমদ রফিকের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ঘনিষ্ঠজন, সংস্কৃতিকর্মী, গবেষকেরা মনে করেন, ভাষা সংগ্রামী হিসেবে ভূমিকা যেমন তাকে কীর্তিমানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে, তেমনি কবি-গবেষক এবং ব্যক্তি আহমদ রফিকও ‘অনন্য এক জীবন কাটিয়ে গেছেন’।
শনিবার (৪ অক্টোবর) ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসে এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিনি সমাজ রূপান্তরের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। ভাষা সংগ্রামী হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। কবিতা লিখেছেন, গবেষণা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ওপর তার গবেষণার কাজ আমাদের নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। শেষদিকে অনেকটা নির্বাসিত জীবনই কাটিয়েছেন।
শনিবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় ভাষা সংগ্রামীরমরদেহ। এ সময় সর্বস্তরের মানুষ মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে ফ্রিজিং গাড়িতে করে শোক শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে আহমদ রফিকের মরদেহ সেগুনবাগিচার বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আহমদ রফিকের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মরদেহ বারডেম হাসপাতালে দান করা হয়।
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য আহমদ রফিক তার মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন বলে আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছেন।
বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১২ মিনিটে আহমদ রফিকের জীবনাবসান হয়; তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্রনিক কিডনি ফেইলিওর, আলঝেইমার্স রোগ, পারকিনসন্স রোগ, ইলেকট্রোলাইটস ইমব্যালেন্স, বেডশোর, ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন আহমদ রফিক।
আহমদ রফিকের ঘণিষ্ঠজন অধ্যাপক ভীস্মদেব চৌধুরী বলেন, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তার যা সম্পত্তি ছিল, তা তিনি দান করে দিয়েছেন। নানাভাবে সমাজকে তিনি কর্ম দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। আমরা যে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, প্রথম এই শহীদ মিনারের যারা নির্মাতা, তাদের অন্যতম নায়ক ছিলেন আহমদ রফিক।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, তিনি আজীবন সাধনা করে গেছেন। ন্যায়ের পক্ষে থেকে মানুষের মুক্তির জন্য আজন্ম কাজ করে গেছেন। দেশভাগ তাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। আজন্ম সম্প্রীতির সমাজ গড়ার সাধনা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার গবেষণা অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। রবীন্দ্রনাথের সাথে জনমানুষের যে সম্পৃক্ততা, তা আহমদ রফিকের গবেষণায় অনন্যভাবে হয়ে উঠে এসেছে।
আহমদ রফিককে ‘বিরল মানুষ’ মন্তব্য করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, খুব কম মানুষই জীবনের শেষ পর্যন্ত আদর্শকে বহন করে চলতে পারেন। আহমদ রফিক সেই বিরল মানুষদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আজন্ম আদর্শকে বহন করে গেছেন। নিষ্ঠাবান লেখক, গবেষক হিসেবেও তার জীবনযাপন অনন্য। রবীন্দ্র গবেষনায় তাকে সব আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। তার জীবনের আরেকটি দিক হল তিনি সম্পত্তি দান করে আরেক অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। এটি ব্যক্তি আহমদ রফিককে অনন্য করে তুলেছে।
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, আহমদ রফিকের চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য একটা বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে তো উনাকে সবাই চেনেন। উনার লেখা, ব্যক্তিত্ব সবকিছুই তাকে বিশেষ করে তুলেছে।
আহমদ রফিক ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুনীর সিরাজ বলেন, নিঃসঙ্গ জীবন ছিল। আমরা তার কাছে যেতাম। আহমদ রফিক যে পরিমাণ লেখার ভাণ্ডার রেখে গেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দসহ নানা বিষয়ে তার লেখা অফুরন্ত।
২০১৮ সালে আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। এটি নিবন্ধিত ফাউন্ডেশন, যা আহমদ রফিকের সম্মতিতেই তৈরি হয় বলে জানান তিনি।
আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন বলেন, কিছুদিন আগেই তার জন্মদিন গেল, নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। আমরা খবর পাচ্ছিলাম, তার চিকিৎসার টাকা নাই। তার দায়িত্ব কে নেবে, অবশ্যই সরকার তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে। গুটি কয়েক লোক ছাড়া কেউ তার দায়িত্ব নেয়নি। সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে শিল্প-সাহিত্যের মানুষদেরকেও নিজেদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা কিভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি। তা নিয়ে ভাবা উচিত।
আহমদ রফিকের ভাইয়ের মেয়ে রেহেনা আক্তার ঝর্ণা। তিনি বলেন, আমরা কাছ থেকে উনার সংগ্রামটা দেখেছি। তিনি আমার চাচা। আজকে চাচাকে শ্রদ্ধা জানাতে এত লোক এসেছেন, তা দেখে আমি আপ্লুত। আমি পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।
আহমদ রফিকের ভাগ্নে হুমায়ূন কবির বলেন, তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন, গবেষণা করেছেন। আমাদের সকলের উচিত তার কাজকে সংরক্ষণে উদ্যেগ নেওয়া।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে- আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন, ছায়ানট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নতুন দিগন্ত, সমাজ চিন্তা ফোরাম, শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাসদ (মার্ক্সবাদী), লেখক শিবির, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাঘর আসর শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি।
জাতীয় গণফ্রন্ট, দৈনিক প্রথম আলো, বাংলাদেশ জাসদ, ঐক্য ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাংবাদিক ফোরাম, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খামখেয়ালী সভা, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক কমিটি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বুদ্ধিজীবী সংঘ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, মহিলা পরিষদ, ভাসানী জনশক্তি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর গ্রামে। মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর রসায়নে পড়তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ফজলুল হক হলের আবাসিক সুবিধা না পাওয়ায় পরে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ১৯৫২ সালে তৃতীয়বর্ষে পড়ার সময় ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এবং মিটফোর্ডের ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলার কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি সভা-সমাবেশ মিছিলে ছিলেন নিয়মিত।
১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আন্দোলনকারী ছাত্রদের মাঝে একমাত্র তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
১৯৫৫ সালের শেষ দিকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসে পড়াশোনায় ফেরেন আহমদ রফিক। এমবিবিএস ডিগ্রি নিলেও চিকিৎসকের পেশায় যাননি।
১৯৫৮ সালেই আহমেদ রফিকের প্রথম প্রবন্ধের বই ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’ প্রকাশ হয়। তারপর লেখালেখিতেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য উপাধিসহ অনেক সম্মাননা।

Side banner