Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা


দৈনিক পরিবার | সাহান হাসান মার্চ ১৯, ২০২৪, ০৯:০২ পিএম টাঙ্গাইলে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা

টাঙ্গাইল শহরে ইদানিং বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। একই সাথে তারা যুক্ত হচ্ছে মাদক সেবনের সাথেও। ফলে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
বিশেষ করে শহরের ক্যাপসুল মার্কেট, সবুর খান টাওয়ারের সামনের রাস্তা, ছয়আনি পুকুর পার, টাঙ্গাইল সরকারি বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের বড় পুকুর পার, আদালত পাড়া পুকুর পার, শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যান, শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যানের পেছনের নজরুল সেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাসহ পুরো গলি, টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ ময়দানের বাঁশ বাজার, পরিত্যক্ত ভাসানী হল চত্বর সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে এরা দলবেঁধে মিলিত হয়। পরে শহর জুড়ে বিকট শব্দে হর্ণ বাজিয়ে চালায় মোটরসাইকেল মহড়া।
এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন নামে গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রাখে। কোন ঘটনা ঘটলেই এইসব গ্রুপের মধ্যেমে মুহূর্তেই সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায় সেই খবর। এইসব ফেসবুক গ্রুপের মধ্যেমে কোথায় মিলিত হতে হবে, অপারেশন করতে হবে- এমন নির্দেশনাও পেয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট গ্রুপের সদস্যরা।
সম্প্রতি পৌর শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা। ফলে প্রায় প্রতিদিনই কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। যে কোন সময় বেঁধে যেতে পারে বড় ধরনের সংঘর্ষ। ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো ঘটনাও।
এছাড়া এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক সেবনের সাথেও যুক্ত রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জেলা সদরের সৌখিন মৎস্য শিকারি সমিতির আশপাশ এলাকা, পৌর এলাকার শামসুল হক মার্কেটের ২য় তলার খালি অংশ, টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ ময়দানের বাঁশ বাজার, মালঞ্চ সিনেমা হলের আশপাশের এলাকা, শহরের শামসুল হক তোরণ, সরকারি গ্রন্থাগার, কোদালিয়া, নতুন বাস টার্মিনালের পিছনের লেকপার, বেড়াডোমা এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন চিহ্নিত স্পট থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক সংগ্রহ করে প্রকাশ্যেই সেবন করছে কিশোর গ্যাংয়ের এইসব বেপরোয়া সদস্যরা।
এছাড়া শহরে মাদকের সংকট হলেই তারা মাদক সংগ্রহের জন্য মোটরসাইকেল যোগে চলে যাচ্ছে, শহরতলীর গালা ইউনিয়নের মনতলা, মগড়া ইউনিয়নের ছোট বাসালিয়া, ঘারিন্দা রেল স্টেশন, সন্তোষ, অলোয়া জমিদার বাড়ির আশপাশের এলাকাসহ বাইপাস এলাকায়।
শুক্রবার (১৫ মার্চ) পৌর শহরের কলেজ গেট এলাকার হাতেম আলীর ছেলে মামুনকে বিশ্বাস বেতকা এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য পিয়াসের নেতৃত্বে গ্যাংয়ের সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহার করে। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠায়। পরে সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে বর্তমানে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। এবিষয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় আহতের মা মালেকা বেগম বাদী হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) রাতে টাঙ্গাইল আউটার স্টেডিয়ামে অবস্থিত টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমির ছাত্র তরুণ ফুটবলার মো. সজিব হোসেন (১৮) পৌর শহরের সাবালিয়া এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য নুরু ও তার গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে বেদম প্রহারের শিকার হন। তার বাম হাত, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। গুরুত্বর আহত অবস্থায় বর্তমানে সে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে, টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমির কোষাধাক্ষ ও ইনচার্জ, রণজিৎ রায় জানান, ইতিমধ্যে বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বর্তমানে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবী জানাচ্ছি।
সম্প্রতি ডিসি লেকে বেড়াতে আসা বাসাইলের এক কলেজ ছাত্র কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজ ছাত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) সকালে সে ও তার এক বান্ধবী ডিসি লেকে বেড়াতে আসে। ডিসি লেকের শিশু পার্ক চত্বর থেকে একদল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য তাদের আটক করে পাশের একটি ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে যায়। সে ও তার বান্ধবীকে তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পরে তাদের সাথে থাকা টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
সে আরও বলেন, ডিসি লেকের পাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি ফাস্টফুডের দোকানদারদের সাথে এইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই ডিসি লেকে বেড়াতে আসা নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীরা এই ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে।
টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহের কয়েকজন দোকানদার জানান, প্রায় প্রতিদিনই ঈদগাহের পশ্চিম পাশের বকুল গাছের নিচে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের ধরে এনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অত্যাচার চালায়। এসময় রেখে দেওয়া হয় তাদের টাকা-পয়সাসহ মোবাইল ফোন। প্রায় ক্ষেত্রেই এইসব ঘটনার পেছনে প্রেম সংক্রান্ত বিষয় জড়িত থাকে বলেও তারা জানায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিশোর গ্যাঙের দুই সদস্য জানান, টাঙ্গাইলের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের আশীর্বাদে তাদের গ্যাংয়ে প্রায় ২৫ জন সদস্য রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁরা সেই ভাইয়ের পক্ষ হয়ে নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। তার পরিবর্তে তাদের সেই বড় ভাই বিভিন্ন ঘটনায় তাদের শেল্টার দিয়ে থাকে।
সরকারি সৈয়দ মহব্বত আলী ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, কিশোর গ্যাং তৈরি হয় সাধারণত সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক বড় ভাইদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে। বর্তমানে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক অবক্ষয় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাও এই অক্ষয়ের অন্যতম কারণ। ফলে পরিবারে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানদের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ ও শাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে মাদক সেবনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তাদের সন্তানেরা। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং।
টাঙ্গাইল অ্যাডভোকেট বার সমিতির সাবেক সভাপতি মইদুল ইসলাম শিশির বলেন, টাঙ্গাইল শহরে ইদানিং কিশোর গ্যাংয়ের বিচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ও উচ্চবৃত্ত পরিবারের সন্তানরা কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত হচ্ছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা রুজি-রোজগারের আশায় কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত হয়। আর উচ্চবৃত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানেরা থ্রিলারের আশায় কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, এই কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত সদস্যদের পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যারা ইতিমধ্যেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে কেও আর কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত হতে সাহস না পায়।
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল সদর থানার অফিসার-ইনচার্জ (ওসি) মো. লোকমান হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব সারা বাংলাদেশেই আছে, একই অবস্থা টাঙ্গাইল শহরেও। বিষয়টি আমাদের জানা আছে। যখনই তারা কোন অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে সাথে সাথেই সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদকের সাথে যুক্ত হচ্ছে এটাও সত্য। এ কারণে তাদের দ্বারা অপরাধও বেশি সংঘটিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পিছনে রাজনৈতিক বড় ভাইদের হাত থাকে। এই কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমাতে শুধুমাত্র প্রশাসনই নয়, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে এগিয়ে এলে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমিয়ে আনা যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Side banner