Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫, ২২ কার্তিক ১৪৩২

চুক্তির আমলাদের হাতেই প্রশাসন


দৈনিক পরিবার | নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ৬, ২০২৫, ১১:২৫ এএম চুক্তির আমলাদের হাতেই প্রশাসন

মন্ত্রিপরিষদসচিব, মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসনসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা (আমলা)। প্রশাসনের পদোন্নতির সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সাত সদস্যের মধ্যে অন্তত চারজনই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া। এতে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-পদায়নসহ প্রশাসনের ‘লাগাম’ এখন চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের হাতে।
চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া সচিবদের মধ্যে অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা নিয়োগের আগে প্রায় এক যুগ ধরে ছিলেন প্রশাসনিক কাজকর্মের বাইরে। ফলে তাঁদের কেউ কেউ বর্তমান প্রশাসনের কাঙ্খিত ‘মেজাজ’ ধরতেই পারছেন না। এতে প্রশাসনের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। চুক্তির কারণে অনেক নিয়মিত কর্মকর্তাকে অবসরে যেতে হচ্ছে অতিরিক্ত সচিব পদ থেকেই। এতে প্রশাসনে নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে।
গত পাঁচ মাসে অন্তত ২৪ জন গ্রেড ১ ও অতিরিক্ত সচিব অবসরে গেছেন। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, এখনকার চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে গত ১৫ বছর নানাভাবে বঞ্চিত ছিলেন। তবে তাঁদের কয়েকজন দপ্তর ভালোভাবে চালাতে পারছেন না। যাঁরা ভালো করছেন না, সরকারের উচিত তাঁদের চুক্তি বাতিল করা। চুক্তির কারণে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ব্যাহত হয়। এ কারণে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা। 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ মুহূর্তে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ২০ কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ৭১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। 
মন্ত্রিপরিষদসচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহসানুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার) ড. মো. মোখলেস উর রহমান এবং এম এ আকমল হোসেন আজাদ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা) সিদ্দিক জোবায়ের, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যাদা) এ জে এম সালাহউদ্দিন নাগরী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব পদমর্যাদা) ড. কাইয়ুম আরা বেগম, বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব পদমর্যাদা) এস এম মঈন উদ্দিন এবং মকসুমুল হাকিম চৌধুরীকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যদা) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফকে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত পদে। ড. মো. মাহফুজুল হককে পর্তুগালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব পদমর্যাদা) এবং বেগম শরিফা খানকে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক (সচিব পদমর্যাদা) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী স্বৈরশাসনের বিদায়ের এক বছর পরও বিশৃঙ্খল প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্ব পালনে গাফিলতি যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সচিব নিয়োগে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনে চর দখলের মতো চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় নামেন কিছু আমলা। ফ্যাসিবাদের সহযোগী ডিসিদের প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দিতে গিয়ে ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। ডিসি নিয়োগ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন। জনপ্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এক ঘণ্টা ওয়াশরুমে আটকে রাখেন ডিসি নিয়োগে বঞ্চিতরা।
সর্বশেষ শিক্ষাসচিব ও জনপ্রশাসনসচিব নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এমনকি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে একটি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা অতীতের সব রেওয়াজ ভেঙে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যা এখন আমলাপাড়ায় ‘ওপেন-সিক্রেট’। এর মধ্যে ডিসি নিয়োগে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে খোদ জনপ্রশাসনসচিবের বিরুদ্ধে। পরে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে গত ২১ সেপ্টেম্বর বদলি করে পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এর ২১ দিন পর এই পদে বদলি করা হয় চুক্তিতে থাকা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এহছানুল হককে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত দুই দশকে এক দিনের জন্যও সচিব ছাড়া থাকার নজির নেই। এর আগে প্রায় এক মাস খালি থাকার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, দীর্ঘ সময় প্রশাসনের বাইরে থাকায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এসব সিনিয়র সচিব ও সচিব স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে পারছেন না। তাঁরা এখনো সেই ১৫ বছর আগে তাঁদের রেখে যাওয়া প্রচলিত নিয়মে প্রশাসন পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। এমনকি তাঁরা তাঁদের ব্যাচমেটদের (বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত) নিয়ে একটি বলয় তৈরি করে রেখেছেন, যাতে অন্যান্য ব্যাচের দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা প্রশাসনের লাগামে হাত দিতে না পারেন।
এসব কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। মাঠ প্রশাসনে ডিসি নিয়োগে দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

Side banner