জীর্ণশীর্ণ ছোট একচালা ঘরের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা যুবক। বিড়বিড় করে কি যেন একটা বলছেন। এক সময়ের টগবগে যুবক এখন চার দেওয়ালে বন্দি। খুপড়ি ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তার। এক, দুই নয়, এভাবে ছয় বছর ধরে শিকলবন্দি। লোহার শিকল পরা অবস্থায় দিনের শুরু হয় আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। এরপর রাত। তবুও শিকল থেকে মুক্তি মিলছে না তাঁর। এভাবেই হাসি-কান্নার মধ্য দিয়েই কাটছে তাঁর শিকলে বাঁধা জীবন।
আর আদরের সন্তানের চিকিৎসায় সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন দরিদ্র পরিবার। বসতভিটা ছাড়া নিজের বলতে আর কিছুই নেই তাদের। গায়ের মহাজনের কাছে ধার করে চিকিৎসা করিয়েছেন। তবুও সুস্থ্য করা যায়নি ৩৫ বছর বয়সী মিলনকে।
প্রাথমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা মিলন আর পাঁচ শিশুর মতো হাসি-কান্না হই-হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। দুষ্টুমিতে মায়ের কাছে আসতো হাজারও অভিযোগ। জন্মের ৯ বছর বয়সে গলায় টিউমার ধরা পড়ে মিলনের। চিকিৎসা নেওয়ার পরে কিছুদিন সুস্থ হলেও আবার শুরু হয় অসুস্থতা। ৩৫ বছর জীবনে ২৫ বছর অসুস্থ থাকলেও ৬ বছর চার দেওয়াল আর পায়ের শিকলই তার সঙ্গী। তবে বৃদ্ধা মা মারা গেলে কে দেখবে তাকে? এমন চিন্তায় প্রতিনিয়তই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে মা শাহেদা বেগম।
স্বপ্ন ছিলো মিলন হক পড়াশোনা করে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে প্রাথমিকেই থমকে গেছে তাঁর জীবন। অপরিচিতদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করলেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করেন। অনেক সময় নানাভাবে বিড়ম্বনায় ফেলেন স্থানীয়দের। পরিবারে উপার্জনক্ষম মানুষ না থাকায় হচ্ছে না উন্নত চিকিৎসা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া ইউনিয়নের পূর্ব কুজিশহর গ্রামের মফিজ উদ্দীন ও শাহেদা বেগম দম্পত্তির চার সন্তানের মধ্যে মিলন হক ছোট।
বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন অনেক আগেই। আর দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে শশুরালয়ে! আরেক মেয়ে কুলছুম বেগম (৩৭) স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে যোগ হয়েছেন শয্যাশায়ী বাবার পরিবারে। বৃদ্ধা মা শাহেদা বেগম (৬৫) অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পাই তা ছেলে- মেয়ে ও স্বামীর মুখে তুলে দেয়। তবে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও সরকারের পক্ষে থেকে তাঁরা কোন সাহায্য-সহযোগিতা পান না। কয়েকবার সাহায্যের জন্য রুহিয়া ইউনিয়ন পরিষদে গেলেও খালি হাতে ফেরত আসতে হয়েছে দরিদ্র এই বৃদ্ধাকে।
স্বামী মফিজ উদ্দীন (৭০) বছর সাতেক ধরে শয্যাশায়ী, ছেলে শেকলে বাঁধা। স্বামী সন্তানের মুখের খাবার জোগাড় করবেন, না চিকিৎসা করাবেন- এই দোটানায় শাহেদা বেগম। মানুষের বাড়িতে কাজ করে দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করেন তিনি। চিকিৎসা করার আর্থিকভাবে ক্ষমতা নেই। তবে সুচিকিৎসা পেলে ভালো হবে মিলন এমন স্বপ্ন দেখেন তার মা। কিন্তু তার এই স্বপ্নে বাদ সেধেছে টাকা। কারণ টাকা ছাড়া এখন কিছুই মেলে না। তাই ছেলে সুস্থ করতে বিত্তবানদের সাহায্য চান শাহেদা বেগম।
তিনি বলেন, দিনে ও রাতে ছেলের পায়ে, কখনো হাতে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে ঘুমানোর ব্যবস্থা করি। এ দৃশ্য মা হয়ে সহ্য করতে পারছি না। গরীব মানুষ, ঠিকমতো সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ছেলের উন্নত চিকিৎসা করাবো কীভাবে? যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, মিলনের পরিবার খুবই গরিব। চিকিৎসা দূরের কথা, ঠিকমতো একবেলা খাবার জোগানো দায়। তার বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। ছেলেও শিকলে বন্দি। মিলনের প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসার। তা না হলে পরিবারটার সামনে আরও কঠিন সময় আসবে।
তবে দরিদ্র পরিবারের নিয়ে রুহিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল হক বাবু ও ইউপি সদস্য তাহেরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা কথা বলতে চাননি।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, বিষয়টি সত্যিই হৃদয়বিদারক। অতিদ্রুতই মিলন হকের খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে
আপনার মতামত লিখুন :