Daily Poribar
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বর্ষের নতুন প্রত্যয়ঃ সম্প্রীতি হোক অসাম্প্রদায়িক


দৈনিক পরিবার | শাকিল শাহরিয়ার এপ্রিল ১৪, ২০২৪, ১১:১১ এএম নতুন বর্ষের নতুন প্রত্যয়ঃ সম্প্রীতি হোক অসাম্প্রদায়িক

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
                     -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালির বর্ষবরণ, পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষের মাধ্যমে আপামর বাঙালির জীবনে পুনরায় হয় নতুন দিগন্তের সূচনা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব। পয়লা বৈশাখ (বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন তথা বাংলা নববর্ষের শুরু। এই দিনটি বাংলাদেশে এবং প্রতিবেশী ভারতে বিশাল জাঁকজমক করে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালীরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। বিগত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা, হতাশা, জরা, গ্লানি ভুলে নতুন একটি শান্তি ও সমৃদ্ধির বছরকে বরণ করে নেবে বাঙালি।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সন গণনা শুরু হওয়ার পর খাজনা আদায়ের পর যে উৎসব থেকে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল তা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, সম্রাট আকবর তার রাজত্বে খাজনা তোলার প্রক্রিয়া সহজ করতে ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ই মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। নতুন সনটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘ফসলি সন’ পরে যা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়।বাংলা সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সৌর সন ও আরবী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে বাংলা সন ও তারিখ নির্ধারণ করেন। আর এই ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার নাম দেয়া হয় তারিখ-ই-এলাহী। এই পুরো কাজটি করা হয়েছিল ফসল উৎপাদনের ঋতুচক্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যাতে ফসল উঠার সময়টাতেই খাজনা আদায় করা যায়।
এর ধারাবাহিকতায় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করতো। এর পরের দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষ্যে তখন মেলা বসতো। আয়োজন করা হতো আরো নানা অনুষ্ঠানের।নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পূত-পবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে।
বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উৎযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনো বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যূষে নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা  সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন সাধারণত সব শ্রেণীর এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকালবেলা পান্তা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা। এভাবে লোকজ বর্ষবরণ প্রথাগুলির কোনো কোনোটির অনুসরণের মাধ্যমে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে।বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলন মেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়।
বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাঙালির সংস্কৃতির শক্তি নতুন করে আবিষ্কার করা যায় এই দিনে। এটি উৎসবমুখর দিন। সব মানুষ, সব ধর্ম, সবার জন্য সবার জন্য এই পহেলা বৈশাখ।বাঙালি জাতি হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের এমন একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক কাতারে শামিল হয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে সুউচ্চে তুলে ধরতে পয়লা বৈশাখের মতো উৎসব আর দ্বিতীয়টি নেই। সে কারণে এ দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে এক অনন্য তাৎপর্যের দিন।
এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় বৈচিত্র্যতা রয়েছে।  তবে এ অঞ্চলের মানুষ সব সময়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জীবনযাপন করত। আবহমান বাংলার মুসলমান-হিন্দু তথা সব জাতি-ধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় উল্লেখ রয়েছে। পৌষ পার্বণ তথা পয়লা বৈশাখ আবহমান কাল থেকেই বাংলার মানুষের প্রাণের উৎসব। এ উৎসব সবার। এ উৎসব সব সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বের এক চেতনা।
বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ইউনেস্কো বলেছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই আর ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণকেও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয় সংস্থাটি।এ স্বীকৃতি আমাদের জন্য এক বিশাল পাওয়া। বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
বর্ষবরণে মানুষের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি বারবার এটাই প্রমাণ করে যে, বাঙালি ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস করে না, সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না, মানুষে মানুষে বিভাজনে বিশ্বাস করে না। জীবনবোধ, জীবনযাত্রা, প্রকৃতির বিচিত্রতার নিরীখে বর্ষবরণ আমাদের সংস্কৃতি।সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হৃদ্যতার মেলবন্ধনে ভাস্বর পয়লা বৈশাখ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারা, প্রেরণা দেয় সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে। এ উৎসব তাই আবহমান কালের অসাম্প্রদায়িক গণসচেতনতার পদক্ষেপ।
বাঙালি হিসেবে আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে, আমাদের জাতীয় জীবনে এমন উৎসব রয়েছে যা সমাজের প্রতিটি মানুষকে এক অসাম্প্রদায়িকতার সুঁতোয় বাঁধতে সক্ষম। বাঙালি জাতিগতভাবেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভুদ্ধ। আর এসব উৎসব বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এ বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে রেখেছে।
তবে দুঃখের বিষয় বর্তমানে কিছু ধর্মীয় অপশক্তি, যারা মূলত পথভ্রষ্ট এবং জাতিগত ভাবে নিজেকে বাঙালি বলে মনে করে না তারাই মূলত বাঙালির এই অসাম্প্রদায়িক প্রীতির যে বন্ধন তা বিনষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। তাদের কূটকৌশলে প্রায়শই বাঙালিদের মাঝে ধর্মীয়, সামাজিক বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে এবং বাঙালির যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তা লোপ পাচ্ছে।
নববর্ষের এই শুভক্ষণে আমাদের প্রতিটি বাঙালির উচিত বাঙালির যে জাতীয়তাবাদ তাতে নিজেকে উজ্জীবিত করা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনের মাধ্যমে সমাজের সকল ধর্মীয় অপশক্তি যারা মূলত এই আমাদের সমাজের এক ধরনের জরা তাদেরকে পরাজিত করা। অসাম্প্রদায়িকতার অগ্নিস্নানে বাঙালি সমাজ হোক সাম্প্রদায়িক কলুষতা মুক্ত।

Side banner