ছেলেবেলার কথা মনে পরে তখন একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি। সেসময় কারো হাতে ফোন ছিলো না। প্রিয়জনের খোঁজখবর নিতো একমাত্র চিঠি মাধ্যমে। একটা চিঠি বারবার পড়তো, আবার চিঠির জবাবও দিতো। বিদেশ গিয়ে বন্ধু তুমি আমায় ভুলো না, চিঠি দিও পত্র দিও জানাইও ঠিকানা রে . . .। চিঠি নিয়ে লেখা এসব গান স্থান পেয়েছিল সিনেমায়। একসময় গানে থাকা এ কথাগুলোই বুঝিয়ে দেয় চিঠির আবেদন জীবনের সঙ্গে ঠিক কতটা মিশে ছিল। প্রিয়জনের হাতে লেখা চিঠি কিংবা প্রিয়জনকে দেয়া চিঠি দু’য়েরই গুরুত্ব ছিল অনেক। মহাদেব সাহা তার কবিতায় লিখেছেন-
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও, আঙ্গুলের মিহিন সেলাই ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতোৃৃ.। কবি নরেশ গুহ লিখেছেন, যদি আজ বিকেলের ডাকে তার কোন চিঠি পাই? যদি সে নিজেই এসে থাকে যদি তার এতকাল পরে মনে হয় দেরি হোক, যায়নি সময়?
“চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও। নইলে থাকতে পারবো না”- কাগজে লেখা চিঠির আবেগের ভাষা হৃদয়ের গভীরে যে ক্ল্যাসিক্যাল সুর তোলে যন্ত্রের চিঠি কি তা কখনো পারবে? যন্ত্রের চিঠি যে যত্নে তুলে রাখা যায় না, ইচ্ছে হলে কাপড়ের ভাঁজ থেকে বের করে গালের সাথে চেপে ধরা যায় না।
একটা চিঠিতে আগে যতটা স্নেহ, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো একটা খুদে বার্তায় কখনোই তা প্রকাশ পায় না। খুদে বার্তা আসলেই বড্ড খুদে, এতে যতটুকু জানতে চাওয়া হয় খুব কার্পণ্যের সাথে শুধু ততটুকুই জানানো হয়। অথচ দূর অতীতে একেকটি চিঠিতে ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে এলাকার সার্বিক খবরাখবরও তুলে ধরা হতো, যেন হাতে লেখা ছোট্ট একখানা খবরের কাগজ পড়ছি।
কখনো কখনো চিঠির হাতের লেখার পরিবর্তনের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলে লেখকের আবেগের তারতম্য অনুধাবন করা যেতো। খুশির সংবাদের চিঠি গুলো লেখার সময় কোনো কোনো শব্দ কলমের ডগা থেকে সাদা কাগজে বেরিয়ে আসার সময় উত্তেজনায় লেখকের আঙুল কেঁপে উঠত, দুঃসংবাদের চিঠি গুলোতে খুঁজলে হয়তো দুই আধ ফোঁটা চোখের জলের দাগও পাওয়া যেতো।
আপনজনের চিঠির মমত্ববোধের সঙ্গে প্রিয়জনের চিঠি, ভালো-লাগার মানুষের প্রণয়ের চিঠির যে কত মাধুর্য আর মধুময়তায় নাড়া দিত হৃদয়ের অনুভবে! পুরনো দিনের চিঠি আজও প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের জীবন অধ্যায়ের পাতা হয়ে আছে। একটা সময় ডাকপিয়নেরও কদর ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি বিলি করার নানা মজার ঘটনা এখনো অনেকের স্মৃতিতে অমলিন। অনেক ডাকপিয়ন প্রণয়ঘটিত অনেক বিয়ের নীরব সাক্ষী। পিঠে চিঠির বস্তা নিয়ে ঝুনঝুন ঘণ্টা বাজিয়ে রাতের আঁধারে রানার চলত দূরের পথে।অথচ চিঠির যুগে অনেকের সংগ্রহ করা চিঠি পরবর্তীতে আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, চিঠিতে প্রেয়সীকে লেখা কবিতা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে মানুষের জীবন প্রকৃতি ও সমাজ উঠে এসেছে। বাট্রান্ড রাসেলের লেখা চিঠি নিয়ে প্রকাশিত ‘আনআর্নড ভিক্টরি’ এখন শান্তির পথ নির্দেশক হয়ে আছে।
কালের বিবর্তনে চিঠির আবেদন ফুরিয়েই গেছে। এখন আর লাল, হলুদ বাক্সে চিঠি জমা হয় না প্রিয়জনের জন্য। ম্যাসেজ, ই-মেইল কিংবা ভিডিও কলের ওপর এতটাই মানুষ মজেছে যে হাতে লেখা চিঠির আর দরকারই পড়ে না তেমন একটা। এখনও পোস্টমাস্টার ও পিয়ন নিয়ম করেই ডাকঘরে আসেন, তবে কাজ না থাকায় কাটাতে হয় অলস সময়। হবে না’ই বা কেন? কেউ এখানে আর চিঠি পাঠাতে আসে না, মানি অর্ডার করতেও আর কারও আগমন ঘটে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘর রয়েছে। ডাকঘরগুলো টিকে আছে মানি ট্রান্সফার, সঞ্চয় গ্রহনসহ নানা বিকল্প সেবার মাধ্যমে। অযত্ন, অবহেলা আর অব্যবহৃত হয়ে শতাধিক ডাকঘরই অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। মাসের পর মাস খোলা হয়নি এমন ডাকবাক্সের সংখ্যাও কম নয়।
ডাক সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসরকারি কোম্পানিগুলো চিঠি আদান-প্রদানে আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে এলেও ডাক বিভাগ এখনও পড়ে আছে সেই আগের যুগেই। আর এ কারণেই মানুষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসকে। প্রত্যাশিত সেবা না পাওয়ার ফলে এই ডাকসেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সবাই।
ডাকের পোস্টাল সার্ভিস বিভাগের এক হিসাবে দেখা গেছে, মোবাইল ফোনসহ যোগাযোগের নিত্যনতুন সব মাধ্যমের আধিপত্যের কারণে প্রতি বছর অন্তত ১ কোটি হারে কমছে ডাকের সাধারণ চিঠিপত্র লেনদেনের সংখ্যা। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যহারে কমছে রেজিস্টার্ড চিঠি ও পার্সেলের সংখ্যা।
আমাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাকসেবারও উন্নতি ও আধুনিকায়ন করা উচিত। তবেই ঐতিহ্য আর বর্তমান চাহিদা মিলে আবারও প্রাণ ফিরে পাবে এই লাল বাক্সগুলো।
বিজ্ঞজনরা বলছেন, চিঠি যতই অতীত হোক আমরা কিন্তু আবার বিশেষ ক্ষেত্রে চিঠির ব্যবহার শুরু করতেই পারি। আধুনিক যুগে সময়ের গুরুত্বে হয়তো সব সময় সম্ভব নয় তবে বিশেষ বিশেষ সময়গুলোতে একটা এক পাতার চিঠি অনেক দামি উপহারকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।
প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা প্রিয় মানুষকে, বাবা-মা কে ডাকযোগে বছরে একটি করে চিঠি পাঠাই। বাঁচিয়ে রাখি ডাকঘরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে।
আপনার মতামত লিখুন :