বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে চীন। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণী বেইজিং, সাংহাই, উহান, গুয়াংজু, শিয়ামেনসহ চীনের বিভিন্ন শহরে পড়াশোনা করছেন। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসায় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রায় সব ক্ষেত্রেই চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বিশ্বমানে জায়গা করে নিয়েছে। শিক্ষার মান, আধুনিক গবেষণাগার, বৃত্তির সুযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিবেশ চীনকে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে শিক্ষা সহযোগিতা
চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে শিক্ষাখাতের সম্পর্ক দৃঢ় করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর বড় উপকারভোগী। প্রতি বছর চীনা সরকারের স্কলারশিপ কাউন্সিল (সিএসসি) এবং চীনা দূতাবাসের উদ্যোগে শতাধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পূর্ণ বা আংশিক বৃত্তি পেয়ে চীনে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
চীন সরকার শুধু শিক্ষার সুযোগই নয়, বরং দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও কাজ করছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চীনে গিয়ে শুধু পড়াশোনাই করছেন না, বরং চীনা সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পাচ্ছেন।
চীনে পড়াশোনার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাইনিজ ভাষার এইচএসকে লেভেল ৪ (চার) পাস করা।
আব্দুল্লাহ আল জাবের জানান, কোনো শিক্ষার্থী এই লেভেল পাস না করলে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গ্রাজুয়েট ডিগ্রি সার্টিফিকেট দেবে না।
চীনের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা: কম খরচে বিশ্বমানের সুযোগ
চীনে এখন প্রায় তিন হাজার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ ৫০০’র তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে ৎিসংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়, ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংহাই জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সাধারণত ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, মেডিসিন, কৃষি, ব্যবসা প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে পড়ছেন। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান ক্রমেই বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সুবিধা। এছাড়া উন্নত গবেষণাগার ও আধুনিক ক্যাম্পাস সুবিধার কারণে পড়াশোনার মানও ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে চীন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কারণ হলো কম খরচে বিশ্বমানের শিক্ষালাভের সুযোগ। চীনে একটি স্নাতক কোর্সের বার্ষিক ফি সাধারণত ২০-৫০ হাজার ইউয়ান (প্রায় ২-৫ লাখ টাকা), যা ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম।
বর্তমানে ‘স্টাডি ইন চায়না’ প্রোগ্রামের আওতায় পাঁচ লাখেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করছেন, যার মধ্যে প্রায় পাঁচ শতাংশই বাংলাদেশি।
বৃত্তির সুযোগ: শিক্ষার খরচ নয়, বিনিয়োগ
চীনে পড়াশোনার অন্যতম আকর্ষণ হলো বিপুল বৃত্তির সুযোগ। চীনা সরকার, প্রাদেশিক প্রশাসন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি দিয়ে থাকে। চায়না স্কলারশিপ কাউন্সিলের (সিএসসি) আওতায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি, আবাসন, মাসিক ভাতা ও স্বাস্থ্যবিমাসহ সম্পূর্ণ সহায়তা পান। এছাড়া ‘সিল্ক রোড স্কলারশিপ’, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ফেলোশিপ’ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ভর স্কলারশিপ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একাংশ নিজস্ব অর্থায়নে পড়তে গেলেও তুলনামূলকভাবে চীনের টিউশন ফি ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম হওয়ায় খুব বেশি চাপে পড়তে হয় না। বেইজিং বা সাংহাইয়ের মতো শহরে বসবাসের খরচ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
নানজিং টেক ইউনিভার্সিটি এবং বিজিএলইউ চায়না লিংক প্রোগ্রামেও বাংলাদেশিদের জন্য পূর্ণ বৃত্তি রয়েছে। এইচএসকে (চাইনিজ ভাষার পরীক্ষা) স্কোর থাকলে আইইএলটিএস ছাড়াই এসব বৃত্তির জন্য আবেদন করা যায়।
জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ও বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা মূলত এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত), বিজনেস এবং মেডিসিন প্রোগ্রামে আগ্রহী। চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, এমবিএ এবং মেডিসিন কোর্স তাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
চীনের গুয়াংজি প্রদেশের বেইবু গালফ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজির (সিএসটিআই) সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জাবের জানান, সেখানকার পড়াশোনার পরিবেশ যথেষ্ট ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্ম সুবিধা অনেক উন্নত, এমনকি ইউরোপীয় অনেক দেশের তুলনায়ও বেশি আরামদায়ক।
তিনি জানান, চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের যোগ্যতাও আন্তর্জাতিক মানের। বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং মেজরের শিক্ষকরা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা থেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি করেছেন। এ কারণে তারা শিক্ষার মান অনেক ভালোভাবে বজায় রাখতে সক্ষম। তবে স্থানীয় কিছু শিক্ষকের ইংরেজি তেমন ভালো না হওয়ায় মাঝে মধ্যে বিষয়বস্তু বোঝা কিছুটা কষ্টকর হয়ে যায়।
অন্যদিকে, চীনের পেকিং, ফুদান ও সাংহাই জিওতং বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ও আইন বিষয়ের জন্য জনপ্রিয়। বিজিএলইউ চায়না লিংক প্রোগ্রাম আইন ও অর্থনীতিতে ভালো। নানজিং টেক ইউনিভার্সিটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফুল ফান্ডেড সুযোগ দেয়।
আবেদন প্রক্রিয়া
চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন সহজ এবং অনলাইনে করা যায়। সিএসসি স্কলারশিপের জন্য পধসঢ়ঁংপযরহধ.ড়ৎম বা পংপ.বফঁ.পহ-এ আবেদন করতে হয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, স্টেটমেন্ট অফ পারপাস, রেকমেন্ডেশন লেটার এবং এইচএসকে/আইইএলটিএস স্কোর (যদি প্রয়োজন হয়)। ডেডলাইন সাধারণত ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল। বাংলাদেশে চীন দূতাবাস প্রি-স্ক্রিনিং করে থাকে, যা আবেদন সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়ায়। চীনের ভিসা (এক্স১/এক্স২) পাওয়ার জন্য স্কলারশিপ অফার লেটার প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেশ কিছু কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান আবেদন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে থাকে।
পার্ট-টাইম চাকরি
চীনে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পার্ট-টাইম চাকরির সুযোগ আছে, কিন্তু এটি কঠোর নিয়মাবলী এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০২২ সাল থেকে চীন সরকার এই সুযোগকে কিছুটা শিথিল করেছে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের অর্থনৈতিক চাপ কমাতে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। তবে, এটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করা যায় না, এর জন্য অবশ্যই ইউনিভার্সিটির অনুমোদন এবং সরকারি পারমিট দরকার হয়। বিনাঅনুমতিতে কাজ করলে মোটা অংকের জরিমানা, ভিসা বাতিল বা দেশ থেকে বিতাড়নের ঝুঁকি রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ
চীনে পড়াশোনার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাইনিজ ভাষার এইচএসকে লেভেল ৪ (চার) পাস করা। আব্দুল্লাহ আল জাবের জানান, কোনো শিক্ষার্থী এই লেভেল পাস না করলে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গ্রাজুয়েট ডিগ্রি সার্টিফিকেট দেবে না। ভাষা সমস্যা ছাড়াও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং স্কলারশিপ না পাওয়া গেলে খরচও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে যারা এইচএসকে ৪ পাস করে, তাদের জন্য চাকরির সুযোগ অসাধারণ। চীন বা বাংলাদেশের উভয় ক্ষেত্রেই তারা উচ্চমানের চাকরি পেতে পারে।
পরামর্শ
চীনে পড়াশোনার জন্য আগে থেকে চাইনিজ ভাষা শেখা গুরুত্বপূর্ণ।
স্কলারশিপ-ভিত্তিক আবেদন করুন।
বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করুন।
আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব ও গবেষণা সুবিধা ব্যবহার করুন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ সরকার চীনের সঙ্গে শিক্ষা সহযোগিতা জোরদার করছে। দুই দেশের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌথ গবেষণা, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও অনলাইন শিক্ষায় সহযোগিতা বাড়ছে। উহান বিশ্ববিদ্যালয়, দালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, এবং ইউনান বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা সমঝোতা করেছে। কৃষি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও তথ্যপ্রযুক্তি এই চারটি খাতে যৌথ গবেষণায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
এছাড়া চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (যেমন- হুয়াওয়ে ও আলিবাবা) বাংলাদেশের তরুণদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা শেষে এসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ কিংবা চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন।
সুতরাং, চীনের উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এক বিশাল সুযোগ, যা তাদের শিক্ষাগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে নেবে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং ভাষা দক্ষতার মাধ্যমে এই স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন :